গাজা–এক নতুন কবিতা // মূল: বেন ওকরি// অনুবাদ: মাজহার জীবন

১.
আমি জানি না এ যাবত কতজন মারা গেছে
কিংবা কতজন মারা গেছে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আগে।
সবার কথা শোনার কোনো না কোন উপায় অবশ্যই আছে
যে যন্ত্রণায় মানুষ পুড়ছে তা শোনার
কোনো না কোন উপায় অবশ্যই আছে।
যন্ত্রণা যন্ত্রণার জন্ম দেয় – সে যন্ত্রণায় মৃত্যু ঘটে
হৃদয়ের। দূরে বসে এইসব বিপন্নতাকে মনে হয়
অবাস্তব। নয়তো কীভাবে মহাশক্তিধরেরা
বোমা আর মিসাইল দাগিয়ে যাচ্ছে সেই দূর্দশারে লক্ষ্য করে
যা প্রতিনিয়ত আগুন আর ক্রোধ হয়ে ছেয়ে ফেলছে তাবৎ বিশ্বটাকে?ঁ
নিরাপরাধ শিশু ও তাদের মায়েদের মৃত্যুর প্রতি কীভাবে আমরা এতোটা বধির হয়ে পড়লাম?
এক মৃত্যুর মূল্য আমরা কীভাবে আরেক মৃত্যু দিয়ে চুকাতে শুরু করলাম,
কীভাবে নির্ণয় করে ফেললাম এক পক্ষের একজনের মৃত্যু
অন্য পক্ষের হাজার জনের মৃত্যুর সমান?
.
দুনিয়ার আত্মা মরে গেছে নিশ্চয়ই।
এও নিশ্চিত যে আমরা একেবারে আমাদের রক্তশিরা অবধি পাথরে পরিণত হয়েছি।
এখানে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবি
কেমন করে আমাদের আত্মা
এমন নিস্পৃহ হয়ে গেল যে
আমরা খাবার খেতে পারছি, কাজে যেতে পারছি
এমনকি পরিবারে হাসি-মস্করা করতে পারছি
অথচ আমরা জানি এই ক্ষণজীবী স্বপ্নের
ওপাড়ে অনাহারে ভুগছে হাজার হাজার মানুষ,
গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি, নস্যাৎ করা হয়েছে জীবন।
.
এমন কোনো ধর্ম থাকার কথা নয় যে ধর্ম এই দুর্দশায়
আমাদের সকলকে উদাসীন থাকতে শেখায়।
নিশ্চয়ই কোনো একটা গন্ডগোল হয়েছে এই দুনিয়ার ।
আমাদের মানবিকতা আটকে গেছে কোনো এক গোলকধাঁধায়।
আমার এমন অনেক বন্ধু আছে তাদের কুত্তা হারিয়ে গেলে কেঁদে আকুল হয়
অথচ গাজায় গুড়িয়ে দেয়া বাড়িঘর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ তাদের কানে পৌঁছায় না।
জটিলতার প্যাঁচে পরে এমন অনুভূতিশূন্য হয়ে যেতে পারে না আমাদের হৃদয়।
যন্ত্রণা যন্ত্রণার জন্ম দেয়–আর সেই যন্ত্রণা মানুষ হওয়ার বদলে মানুষকে পাথর বানায়।
.
মানবিকতার মহিমার সাথে সত্যের
বিরোধ নেই কোনো। যে কোনো মহা-অবিচারে দুনিয়ার
নির্লিপ্ততা যেন সমস্বরে উচ্চারিত আর্তনাদ। আমরা নিঃশ্বাস নেই
জীবনের ধ্বংসস্তুপের ভেতর যা কিনা আমাদের নজরেও পড়ে না।
আমাদের স্বপ্নে আমরা তাদের সাথে মরে যাই। আমাদের ঘুমের ভেতর
আমাদের আত্মা তাদের সাথে মাতমে মাতে, কারণ তারা যে পক্ষেরই হোক না কেন
তাদের মৃত্যু মানে আমাদেরও মৃত্যু। সময়ের সাথে সাথে
আমরা অসুস্থ হতে থাকি। জখমে জখমে
কুঁচকে যাই। আমরা নীরব থাকি কিংবা না থাকি
এই সব গণহত্যার দায়ে আমরা কলুষিত। মানুষ হত্যা করে
কোনো সভ্যতা টিকে থাকতে পারে না। আমাদের নীরবতার মধ্য দিয়ে আমরা
আমাদেরই ধ্বংস প্রত্যক্ষ করছি। অজ্ঞতা কিংবা মিথ্যার মানে শান্তি হতে পারে না।
.
কি কি সহ্য করছি কতখানি সহ্য করছি তারই নিক্তিতে মাপা হয় আমাদের,
নিজেদের মানসিক শান্তির আশায় যেসব মর্মবেদনা
আমরা উপেক্ষা করি, নীরব থাকি সে সবই ঐ নিক্তির বাটখারা।
আর আমাদের নীরবতা মিসাইলেরই সহায়ক। ঐসব শিশুর রক্তে রঞ্জিত
আমাদের নীরবতা। আর আমরা যে প্রতিদিনই
দূরে সরে যাই, বন্ধ করে দেই আমাদের হৃদয় কপাট
তাতে নীচে, মনুষ্যজাতির সর্বজনীন জমিনে
ছড়িয়ে পড়া রক্তের উদ্গিরণ ঘটে আর সেই বিদেহী আত্মারা পরিপুষ্ট হতে থাকে
আমাদের উন্নয়নে ভর করে। কারণ গাজা আসলে ওখানে নয়। গাজা এখানে।

২.
এটা ঠিক যে যুদ্ধ অবশ্যই বন্ধ হবে
বন্ধের একটা পথ পাওয়া যাবেই।
পথ খুঁজে পাওয়ার মানে এই না যে
এক দল বা অপরদলের মানুষদের ধ্বংস করে ফেলা।
ইতিহাস তার শিক্ষা আর শঙ্কা সমেত
আমাদের এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
দাঁড় করিয়েছে এই অসম্ভব গাণিতিক সমীকরণের সামনে
যেখানে আমরা অতীত দিয়ে ভবিষ্যতকে সমাধান করতে পারবো না
রক্ত কিংবা দোষাদোষী কিংবা বোমা
কিংবা ক্ষণজীবী শ্লোগানেও হবে না এর অবসান।
আমি দেখতে পাচ্ছি, সেখানে এক নতুন ভবিষ্যত সম্ভব।
দেখতে পাচ্ছি, ঐ ভূমি
বলিষ্ঠ-অমূল্য-পারস্পরিক-মেলবন্ধনে উর্বর।
দেখতে পাচ্ছি মরুভূমি আবার গানে গানে
জীবন্ত হয়ে উঠছে। দেখতে পাচ্ছি দুই জাতিই
নতুন এক পথ খুঁজে নিচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি এই অলৌকিক ঘটনাই
একমাত্র বাস্তব সমাধান।
সেই সব ঘৃণা, সেই সব ক্রোধ কেবল
অলৌকিক ঘটনা হয়ে ফুটে উঠতে পারে।
যদি আমাদের স্বপ্ন আর ভালোবাসা আমদেরকে
সেখানে পৌঁছে না দেয়, তাহলে এই সব দুর্ভোগই
আমাদের বাতলে দিক এক নতুন পথ।
.
আমি একটা সমুজ্জ্বল ভূমি দেখতে পাচ্ছি
যেখানে দুটো স্বপ্ন গোটা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়ে
সহাবস্থানের পথ খুঁজে নেবে।
এটাই হবে আমাদের কালের
সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা।
কে দেখবে এমন স্বপ্ন, রূপ দেবে বাস্তবে
যখন ফুলের মতো ঝরে পড়ে বোমা আর
শিশুরা কাঁদতে থাকে?
.
কোনো পক্ষ না নিয়ে কে
একটা সমাধানের পথ
বের করবে?
.
কোনো পক্ষ না নিয়ে কে
একটা সমাধানের পথ
বের করবে?
.
আকাশের দিকে
আমার এই তাকিয়ে থাকার মতো
এও নিশ্চিত–
শান্তির আকাঙ্খা একদিন
পূরণ হবেই।
.
এটাই একমাত্র অনিবার্য পরিণতি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *