ফ্রি রেডিও/ মূল: সালমান রুশদি/অনুবাদ: লুনা রাহনুমা/ সম্পাদনা: হাসান সাঈদ

চোরের বিধবা বউটার নখর যখনই ছেলেটার মাংসের মধ্যে সেঁধে গিয়েছিল তখনই আমরা সবাই বুঝে গিয়েছিলাম যে ছেলেটাকে দিয়ে ভাল কিছু হবে না। তবে ছেলেটা ছিল নির্দোষ। একটা সত্যিকারের গাধার বাচ্চা সে। আর এই ধরণের মানুষকে তুমি কিছুই শেখাতে পারবে না।

ছেলেটা একটা চমৎকার জীবন পেতে পারত। ঈশ্বর তাকে নিজের রূপ ঢেলে দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। ছেলেটির বাবা ওর জন্য কবর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে, কিন্তু সেকি ছেলের জন্য প্লাস্টিকের কভার দেয়া সিট আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর সহ একটা সম্পূর্ণ নতুন ফার্স্ট ক্লাস রিক্সা রেখে যায়নি? তাই: ছেলেটার রূপ ছিল, নিজের একটা আয় রোজগারের ব্যবস্থা ছিল, সময় মতো একটা স্ত্রীও পেয়ে যেত। কেবল কয়েকটা বছর হাতে নিয়ে কিছু রুপি (অর্থ) সঞ্চয় করে ফেললেই হতো। কিন্তু না, থুতনিতে এক গোছা চুল গজানোর আগে কিংবা তার দুধ দাঁতগুলো পড়ারও আগে তাকে চোরের বিধবাটার প্রেমেই পড়তে হয়েছিল।

ছেলেটার জন্য আমাদের খারাপ লেগেছে, কিন্তু বুড়োমানুষের পরামর্শ কে শোনে আজকাল?

বলছি: কে শোনে?

ঠিক তাই, কেউ শোনে না। রামানির মতো নিরেট-মগজের রিক্সাওয়ালা অবশ্যই শুনবে না। কিন্তু আমি দোষ দেই ঐ বিধবাটাকে। ঘটনাটা আমি ঘটতে দেখেছি, শোনো, যতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনাটা চোখে সয়েছিল সেই অব্দি প্রায় সম্পূর্ণ ঘটনাটাকে আমি আমার চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি । সেইসময় আমি এই বুড়ো বটের নিচে বসে ঠিক এই হুক্কাটারই ধোঁয়া টানছিলাম, আর পুরো ঘটনার খুব বেশি কিছু আমার নজর এড়াতে পারেনি।

একটা সময় আমি ছেলেটাকে ওর নিয়তির লিখন থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি…

বিধবাটা অবশ্যই আকর্ষণীয়া ছিল, অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। নিষ্ঠুরের মতো বললেও বলতে হয়, এক ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধির মতো মেয়েটা দেখতে ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে গিয়ে মেয়েটার মন মানসিকতা পচে গিয়েছিল। রামানির চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড় হবে সে, যার পাঁচটি সন্তান জীবিত আর দুটি মৃত। একমাত্র ঈশ্বরই জানেন বেঁচে থাকতে মেয়েটার চোর স্বামী চুরি করা আর বাচ্চা জন্ম দেয়া ছাড়া আর কী কাজ করত! কিন্তু লোকটি বিধবা স্ত্রীর জন্য একটা পয়সা সঞ্চয়ও রেখে যায়নি, তাই মেয়েটা রামানির দিকে ঝুঁকেছিল। আমি বলছি না এই শহরে একজন রিক্সাওয়ালা অনেক আয় করে, কিন্তু খাবার হিসেবে দুই নলা ভাত নিশ্চয়ই খালি বাতাসের চেয়ে উত্তম। আর অকেজো এই বিধবাটার দিকে খুব বেশি মানুষ দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাবে না।

ঠিক এইখানে দেখা হয়েছিল ওদের দু`জনের।

একদিন রামানি যাত্রীশূন্য রিকশা টানছিল, কিন্তু সে যথারীতি এমনভাবে হাসছিল যেন কেউ তাকে দশ পয়সা বাড়তি ভাড়া দিয়েছে। রেডিওতে বাজতে থাকা কোনো সিনেমার গান গাইছিল শব্দ করে। মাথার চুলগুলো বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাবার মতো তেল মাখানো। আশেপাশের মেয়েরা সারাক্ষণ ওর দিকে কেমন করে তাকিয়ে থাকে, আর ওর দীর্ঘ পেশীযুক্ত পা দুটি দেখে মন্তব্য ছোড়ে—সে সব না বোঝার মতো বোকা সে নয়।

চোরের বিধবা সেদিন মুদি দোকানে গিয়েছিল তিন পদের মেশানো ডাল কিনতে। আর ডাল কেনার জন্য সে রুপি কোথায় পেয়েছে, সে আমি বলব না। কিন্তু লোকেরা রাতের বেলা বিধবার খুপরির কাছে পুরুষমানুষ দেখেছে। এমনকি তারা আমাকে বলেছে এই মুদি দোকানদারটাকেও নাকি দেখা গিয়েছে কয়েকবার। তবে এই ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো মন্তব্য করব না।

মেয়েটার সঙ্গে সেদিন তার পাঁচটি পুচকিই ছিল। ঠিক সেই সময়, সেখানে, হাত পাখার বাতাসের মতো ঠান্ডা কোমল কণ্ঠে সে ডেকে ওঠে: “এই রিক্সা!” গলা উঁচিয়ে চিৎকার করেছিল, তুমি বুঝবে, একেবারে সত্যিকার সস্তা মেয়েদের মতো করে ডাকা। আসলে আমাদেরকে দেখাচ্ছিল, যেন খুব রিক্সায় চড়ার সামর্থ্য রাখে সে। আর কেউ যেন বসে ছিল তার এইসব দেখতে। রিক্সা ভাড়া মেটাতে গিয়ে নিশ্চয় সেদিন বাচ্চাগুলোকে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আমার মতে সেটি আসলে ছিল মেয়েটার বিনিয়োগ। কারণ মেয়েটা নিশ্চয় রামানিকে বড়শিতে গাঁথবে বলে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। এরপর তারা সবাই একসঙ্গে নিজেদেরকে রামানির রিক্সাটিতে উপুড় করে ঢেলে দিল। রামানি বিধবাকে নিয়ে চলে যায়, সঙ্গে বিধবার পাঁচপাঁচটি বাচ্চাকাচ্চাকেও। রিকশার ওজন বেশ ভারী হওয়ায় রামানিকে লম্বা দম নিয়ে টানতে হচ্ছিল, তার পায়ের শিরাগুলো ফুঁলে উঠছিল। আর আমি মনে মনে ভাবছিলাম, বাপধন! সাবধান, নইলে এই ভারী বোঝা তোমারে সারা জীবন ধইর‍্যা টানতে হবে।

কিন্তু এরপর থেকে রামানি এবং চোরের বিধবাটাকে সবখানে দেখা যেতে লাগল, অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে, জনসম্মুখে। রামানির মা আগেই মরে গেছে তাই ভেবে খুশিই ছিলাম আমি, কারণ এইসব দৃশ্য দেখার জন্য যদি সে বেঁচে থাকত তাহলে লজ্জায় মাথা কাটা যেত।

সেসময় মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় রামানি এই রাস্তায় আসত তার কিছু বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তারা নিজেদেরকে খুব চতুর মনে করত, কারণ তারা ইরানির ক্যান্টিনের পেছন ঘরে চলে যেত নিষিদ্ধ পানীয় পান করতে। কথাটি অবশ্য সবাই জানত। কিন্তু কে কী করতে যাবে? ছেলেরা যদি নিজেদের জীবন নষ্ট করে ফেলে তাহলে সেটি নিয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজনকেই মাথা ঘামাতে দাও।

আমার খারাপ লাগত রামানি এমন কু-সংসর্গে পড়েছে বলে। বেঁচে থাকতে ওর বাবা-মাকে আমি চিনতাম। কিন্তু রামানিকে যখন আমি এসব আজেবাজে কাজ থেকে দূরে থাকতে বলেছি, তখন সে ভেড়ার মতো দাঁত কেলিয়ে হেসেছে, বলেছে আমার ধারণা ভুল,তারা আজেবাজে কিছু করছে না।

বাদ দাও, আমি ভেবেছি মনে মনে।

রামানির দোস্তদের সম্পর্কে আমি জানতাম। ওরা সবাই নয়া যুব আন্দোলনের বাহু বন্ধনী ধারণ করেছিল। তখন সময়টা ছিল সরকারের এক জরুরি অবস্থার সময়, এবং রামানির এই বন্ধুগুলো খুব শান্তিপ্রিয় ছিল না। তাদের নামের সঙ্গে মারপিটের অনেক গল্প জড়িয়ে ছিল। তাই নির্বিবাদী আমি চুপচাপ বসেছিলাম আমার গাছের নীচে। রামানি ওর বন্ধুদের মতো বাহু বন্ধনী ধারণ করেনি কিন্তু সে ছেলেগুলোর সঙ্গে যেত কারণ ছেলেরা তাকে মুগ্ধ করেছিল।

বাহু বন্ধনী পরিহিত এই যুবকগুলো রামানিকে সবসময় তোষামোদ করত। তারা ওকে বলত, তুমি এমন সুদর্শন যুবা, তোমার তুলনায় শশী কাপুর এবং অমিতাভ একেবারে কুষ্ঠরোগীর মতো কুৎসিত, তোমার উচিত বোম্বে চলে যাওয়া এবং চলচ্চিত্রে নেমে পড়া।

ছেলেগুলো রামানিকে এইসব বলে স্তুতি আর তোষামোদ করত কারণ তারা জানত এসব কথা বললে তাস খেলার সময় রামানির কাছ থেকে পয়সা নিতে পারবে এবং রামানি তাদেরকে মদ কিনে খাওয়াবে। যদিও রামানি ছেলেগুলোর চেয়ে বেশি বড়লোক ছিল না। আর তারপর, রামানির মগজভরে গেল সেইসব ফিল্মি স্বপ্নে, কারণ রামানির ভেতরে আর কিছু ছিল না যা ওর মগজের খালি জায়গাগুলোকে পূর্ণ করতে পারত। এটি হচ্ছে আরেকটি কারণ, যার জন্য আমি বিধবা মেয়েলোকটাকে দোষ দেই, কারণ রামানির চেয়ে তার বয়স বেশি ছিল আর তাই তার জ্ঞানও বেশি থাকা উচিত ছিল। মেয়েটার উচিত ছিল দুই তুড়িতে রামানির মাথা থেকে পুরো ব্যাপারটি মুছে দেয়া। কিন্তু না, একদিন আমি নিজের কানে শুনেছি, সবাইকে শুনিয়ে সে বলছিল, “কেবল তোমার শরীরটা নীল না, নয়তো সত্যিই তুমি স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণের রূপ পেয়েছ।” একদম রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে বলছিল সে এইসব! সবাই যাতে জানতে পারে যে তারা দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা! সেদিন থেকে নিশ্চিত ছিলাম আমি, একটা বিপর্যয় ঘটবে।

পরের বার চোরের বিধবাটা যখন আমাদের রাস্তার মুদি দোকানে এলো, তখন আমি একটা চেষ্টা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার নিজের জন্য নয় কিন্তু ছেলেটির মৃত বাবা-মায়ের খাতিরে অমন একটা … ওর কাছে অপমানিত হবার ঝুঁকি নিয়েছিলাম আমি। না, ঐ মেয়েটাকে আমি অমন গালি দেব না । সে অন্য কোথাও চলে গেছে, সেখানকার লোকজনই জেনে যাবে সে কেমন।

“চোরের বৌ!” আমি ডাকলাম।

দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। তারপর এমন কুৎসিতভাবে মুখটা ঝাঁকালো, যেন আমি তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করেছি।

“এখানে আসো, কথা আছে।” আমি বললাম।

এবার সে আমার ডাক প্রত্যাখ্যান করতে পারল না, কারণ আমাদের শহরে আমি গুরুত্বহীন মানুষ নই। আর মেয়েটি হয়তো হিসেব কষে ছিল যে আশেপাশের লোকেরা যদি আমাদের দু`জনকে কথা বলতে দেখে তাহলে এরপর যখন সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে তখন আর তারা ওকে আগের মতো উপেক্ষা করবে না। এবং মেয়েটি এসেছিল, যেমনটা আমি জানতাম সে আসবে।

“আমাকে শুধু এই কথাটা বলতে হবে,” উপযুক্ত সম্মান বজায় রেখে বললাম আমি। “রিকশাওয়ালা রামানি ছোকড়াটা আমার প্রিয়জন। তাই তোমাকে এবার অবশ্যই ওকে বাদ দিয়ে নিজের বয়সী কাউকে খুঁজে নিতে হবে, অথবা, সবচেয়ে ভালো হয় তুমি বানারাসে বিধবাদের আশ্রমে চলে যাও আর সেখানে বাকি জীবনটুকু ধর্ম কর্ম করে কাটিয়ে দাও। ওখানে বসে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাও যে বিধবা-পোড়ানো অবৈধ করা হয়েছে।”

এই পর্যায়ে এসে মেয়েটি চিৎকার করে আমাকে অপমান করার চেষ্টা করে। আমাকে সে অভিশাপ দিয়ে বলে যে আমি হচ্ছি এক বিষাক্ত বুড়ো, যার আরো অনেক বছর আগে মারা যাওয়া উচিত ছিল। তারপর মেয়েটি বলে, “আমার কাছে শুনুন, জনাব অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সাহেব, আপনার রামানি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে এবং আমি না বলেছি। কারণ আমি আর ছেলেপুলে চাই না। রামানি একটা ব্যাটাছেলে, তাই তার নিজের ছেলেপুলে হওয়া দরকার। দয়া করে আপনি এই কথাটা পুরো দুনিয়াকে জানিয়ে দিবেন আর আমার ওপর আপনার অপবাদ আর অভিশাপের বিষ ঢালা বন্ধ করবেন।”

এই ঘটনার পর কিছুদিনের জন্য আমি রামানি এবং চোরের বিধবার ব্যাপারে আমার চোখ বন্ধ করে ছিলাম, কারণ আমার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব ছিল, আমি সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। তাছাড়া আমার মতো একজন ব্যক্তির মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো শহরে আরো অনেক কিছু ছিল।

উদাহরণস্বরূপ বলি, স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা একদিন সড়কের উপর একটা বড় সাদা ভ্যান গাড়ি এনে উপস্থিত করে। এবং সেই ভ্যানটাকে বটগাছের নিচে রাস্তার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। প্রতি রাতে কিছু পুরুষদেরকে কিছু সময়ের জন্য এই ভ্যানের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং ওখানে লোকগুলোর সঙ্গে কিছু করা হয়।

এই সময় আমি বটগাছের আশেপাশে থাকার প্রয়োজন বোধ করিনি, কারণ বাহু বন্ধনী পরিহিত যুবকগুলো সবসময় উপস্থিত থাকত ভ্যানের কাছাকাছি। তাই আমার হুক্কাটা নিয়ে আমি অন্যত্র বসতে আরম্ভ করি। যদিও ভ্যানের ভেতরে কী ঘটছে, সে গুজব শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু আমি আমার কান বন্ধ করে রাখি।

কিন্তু শহরে আগত রহস্যময় ভ্যান থেকে ইথারের গন্ধ আসতে থাকার সময়কালেই চোরের বিধবাটার পাপাচারের পরিধি সুস্পষ্ট হয়ে যায় আমার কাছে। কারণ এই সময় রামানি হঠাৎ করে তার নতুন ফ্যান্ট্যাসি সম্পর্কে বলতে আরম্ভ করে। রামানি সবাইকে বলতে থাকে যে খুব শীঘ্রই সে জানতে পারবে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে একটি অত্যন্ত বিশেষ এবং ব্যক্তিগত উপহার সে পাবে কিনা। আর এই উপহারটি একেবারে নতুন, প্রথম শ্রেণীর ব্যাটারি চালিত ট্রানজিস্টর রেডিও।

এখন কথা হচ্ছে: এতদিন পর্যন্ত আমরা বিশ্বাস করতাম যে আমাদের রামানির মাথায় বাস্তবজ্ঞান সামান্য কম আছে। তাই ওর ফিল্ম স্টার হবার স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছাসহ আরো নানা যত চিন্তা, এইসবে আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই সহনশীলভাবে মাথা নেড়েছি। বলেছি, “হ্যাঁ, রাম, ব্যাপারটি তোমার জন্য ভালোই হবে,” এবং “কী চমৎকার, কী মহানুভব আমাদের সরকার যে সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিকে তারা রেডিও উপহার দেয়।”

কিন্তু রামানি জোর দিয়ে বলেছে যে ঘটনাটা সত্য। এবং ছেলেটাকে দেখতে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সুখী বলে মনে হতো। এমন একটি সুখ যা ট্রানজিস্টরের আসন্ন আগমনের অনুমান দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।

স্বপ্নের-রেডিও সম্পর্কে প্রথমবার উল্লেখ করার কিছুদিন পরেই রামানি এবং চোরের বিধবাটা বিয়ে করল। আর আমি সবকিছু পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। তাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম না। সব দিক থেকেই বিয়েটা একটি খারাপ কাজ হয়েছে। কিন্তু খুব বেশি দিন পরের কথা নয়, একদিন যখন সে তার খালি রিকশা নিয়ে বটগাছের কাছে এসেছিল, সেদিন আমি রামের সঙ্গে কথা বলেছিলাম।

রাম আমার পাশে এসে বসার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বাপধন, তুমি কি ভ্যানের ভেতরে গেছিলা? ওরা কি করছে তোমার শরীরে?”

“চিন্তা করবেন না,” রাম উত্তর দিয়েছে। “সবকিছুই চমৎকার চলছে। আমি প্রেমে পড়েছি, মাস্টার সাহেব। আর আমার ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করতে সফল হয়েছি।”

স্বীকার করছি আমি রেগে গিয়েছিলাম; ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম আমি। কারণ বুঝতে পারছিলাম—যে ভ্যানে ঢোকার জন্য অন্যান্য পুরুষদেরকে বাধ্য করা হচ্ছিল রামানি স্বেচ্ছায় সেই ভ্যানের ভেতরে গিয়েছিল নিজেকে অপদস্থ করার জন্য। কড়া করে ঝাড়লাম ওকে। বললাম, “ওরে আমার বোকা মানিক, এই মহিলার পাল্লায় পইড়াই তুমি নিজেকে নিজের পুরুষত্ব থেকে বঞ্চিত করেছ।”

“ব্যাপারটা এত খারাপ না,” রামানি বলে, নাশ-বন্দির (পুরুষের নির্বীজীকরণের অস্ত্রোপচার) কথা বুঝিয়েছে সে। “এটা ভালোবাসা-বাসি বা অন্য কিছুতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না। মাস্টার সাহেব আমাকে মাফ করবেন, এই ধরনের কথা বলার জন্য। এটি শুধুমাত্র বাচ্চার আগমনকে থামায়। আর, আমার স্ত্রী আর সন্তান চান না। তাই এখন সবকিছু শত ভাগ ঠিক আছে। এমনকি দেশের জনসংখ্যার স্বার্থেও কাজটা ভালো হয়েছে,” রামানি উল্লেখ করে। “আর শীঘ্রই আমার জন্য বিনামূল্যে একটা রেডিও আসবে।”

“ফ্রি রেডিও,” পুনরাবৃত্তি করি আমি।

“হ্যাঁ, সেই সময়ের কথা মনে করে দেখেন মাস্টার সাহেব,” আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে রাম, “কয়েক বছর আগে, আমার বাল্যকালে, যখন লক্ষ্মণ দর্জি এই অপারেশন করিয়েছিল? আর সঙ্গেসঙ্গেই একটি রেডিও এসে উপস্থিত হয়েছিল। সমস্ত শহর থেকে লোকেরা এসে জড়ো হয়েছিল রেডিও শুনতে। আমাদের সরকার এইভাবে ধন্যবাদ জানায় জনগণকে। রেডিও পাওয়া বেশ চমকপ্রদ একটা ব্যাপার হবে।”

“ভাগো, আমার কাছ থেকে দূরে যাও,” চরম হতাশার সঙ্গে চিৎকার করেছি আমি। দেশের অন্যান্য সবাই যে কথাটা আরো আগে থেকেই জানে, সেটা ওকে জানানোর মতো ইচ্ছা ছিল না আমার। কথাটা হচ্ছে যে সরকার থেকে ফ্রি রেডিও দেওয়ার যে প্রকল্পটা ছিল সেটা এখন একটি মৃত হাঁস। অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। অতীত হয়ে গেছে। রেডিও বিতরণের উৎসব শেষ – ফুট্টুশ! – অনেক বছর আগেই।

…. ….. ….. …

এই সমস্ত ঘটনার পর চোরের বিধবা, যে এখন রামের স্ত্রী, শহরে খুব একটা আসে না আর। সন্দেহ নেই, রামকে সে যে কাজটা করতে বাধ্য করেছে তাতে সে খুবই লজ্জিত। তবে রামানি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে রিক্সা চালায়। প্রতিবারই কয়েক ডজন লোককে একত্রে দেখলে সে রেডিওর গল্প শোনায়। কানের কাছে একটি করতল অর্ধবৃত্তাকারে এমন ভঙ্গিতে উঁচু করে ধরে যেন বিস্ফোরক মেশিনটাকে সেখানে ধরে রেখেছে। আর একটি সুনির্দিষ্ট জবরদস্ত দক্ষতায় রেডিওর সম্প্রচার নকল করতে থাকে।

“আকাশবাণী থেকে বলছি,” রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করত সে। “এটা অল-ইন্ডিয়া রেডিও। এখন পড়ছি সংবাদ। একজন সরকারী মুখপাত্র আজ ঘোষণা করেছেন যে রামানি নামের রিকশাওয়ালার রেডিওটা এখন গন্তব্যপথে রয়েছে এবং যেকোনও মুহূর্তে সেটি তার হাতে পৌঁছে যাবে। এখন শুনবেন কিছু সিনেমার গান।” এরপর রাম ভীষণ চিৎকারে হাস্যকরভাবে কণ্ঠস্বর নকল করে আশা ভোঁসলে বা লতা মঙ্গেস্করের গান গাইত।

নিজের স্বপ্নের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে রাখতে পারার বিরল গুণ ছিল রামের। এবং এমন একটা সময় এসেছিল যখন কাল্পনিক রেডিও পাবার ব্যাপারে তার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদেরকেও প্রায় পেয়ে বসে ছিল। যখন আমরা আধা-বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম যে রেডিওটা সত্যিই আসছে। এমনকি ইতিমধ্যে রেডিও চলেই এসেছে, আর সেটি রামের কানের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে জুড়ে আছে আর সে রিকশা টেনে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। আমরা আশা করতে লাগলাম আশেপাশে বা গলির শেষ প্রান্তে রাম রিক্সার ঘণ্টা বাজিয়ে প্রফুল্ল চিৎকারে বলছে:

“অল-ইন্ডিয়া রেডিও! আপনারা শুনছেন অল-ইন্ডিয়া রেডিও!”

… …. …. ..

সময় অতিবাহিত হতে থাকে। রাম এখনো শহরের সবখানে তার অদৃশ্য রেডিওটা বহন করে বেড়ায়। একটি বছর পার হয়ে গেছে। এখনো তার রেডিও চ্যানেল অনুকরণ করে করা কান্ডকীর্তিতে রাস্তার বাতাস ভরে ওঠে। কিন্তু এখন যখন আমি ছেলেটাকে দেখি, তার চেহারায় একটা নতুন জিনিস লক্ষ্য করি। একটা চাপা কিছু, যেন ছেলেটাকে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হচ্ছে। এই চেষ্টা রিকশা চালানোর চেয়ে অনেক বেশি ক্লান্তিকর। এমনকি চোরের বিধবা এবং তার পাঁচটা জীবিত সন্তান এবং দুটি মৃত সন্তানের ভূত ঘাড়ে নিয়ে রিক্সা টানার চেয়েও বেশি ক্লান্তিকর। মনে হতো যেন ছেলেটা যৌবনের সমস্ত শক্তি ঢেলে দিয়েছে তার কান আর করতলের মধ্যখানের কাল্পনিক জায়গাটুকুতে, আর সে এক প্রবল শক্তিশালী, এবং খুব সম্ভবত ভয়াবহ কোনো ইচ্ছাশক্তির দ্বারা রেডিওর কাল্পনিক অস্তিত্বকে বাস্তবায়িত করতে চাইছে।

সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করতাম আমি। আর সেই কারণটাও বলতে পারি আমি। কারণটা হচ্ছে, আমি আবিষ্কার করেছিলাম রাম যে ভুল কাজটি করে ফেলেছে তার জন্য সে যাবতীয় উদ্বেগ এবং অনুশোচনা ঢেলে দিয়েছে এই কল্পিত রেডিওটির মধ্যে। আর শেষপর্যন্ত মরে যাওয়াই যদি তার স্বপ্ন হয়ে থাকে তবে সে নিজের শরীরের বিরুদ্ধে করা অপরাধের বিষয়টা উপলব্ধি করতে বাধ্য হবে। রামানি বুঝতে পারবে যে, বিয়ের আগেই চোরের বিধবাটা তাকে একটি নির্বোধ এবং ভয়ংকর ধরণের চোরে পরিণত করেছিল। কারণ নিজেকেই নিজে হরণ করতে মেয়েটা তাকে বাধ্য করেছিল।

তারপর একদিন সাদা ভ্যানটি বটগাছের নিচে আগের নির্দিষ্ট স্থানে আবার ফিরে এলো। আর আমি জানতাম কিছু করার নেই। কারণ রাম অবশ্যই তার উপহার নিতে আসবে।

… … …

প্রথম দিন সে এলো না, তারপর দুদিন। এবং এরপর আমি বুঝেছি যে রাম চায়নি কেউ তাকে লোভী মনে করুক; চায়নি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মনে করুক রামানি রেডিওর জন্য মরিয়া হয়ে আছে। তাছাড়াও, সে খানিক আশা করেছিল যে সরকারের লোকজন তার কাছে যাবে। তার বাড়িতে গিয়ে জিনিসটি হাতে তুলে দেবে। সম্ভবত কোনো ধরণের ছোটখাটো আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে হস্তান্তর করা হবে বিশেষ রেডিওটা। যে বোকা সে বোকাই, তার বোকামীর জন্য কোনো কারণ লাগে না।

তৃতীয় দিনে সে এলো। তার সাইকেল-বেল বাজিয়ে এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুকরণ করতে করতে। যথারীতি কানের কাছে একটি করতল অর্ধবৃত্তাকারে ধরা। ভ্যানের কাছে এসে পৌঁছেছে রাম, ওর পিছনে রিকশায় বসেছিল চোরের বিধবা, শয়তান ডাইনিটা, যে নিজের চোখে সঙ্গীর ধ্বংস দেখার জন্য না এসে থাকতে পারেনি।

খুব বেশি সময় লাগেনি।

রাম তার বাহু-বন্ধনী পরিহিত বন্ধুদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বেশ ফূর্তির সঙ্গে ভ্যানের ভেতরে ঢুকে গেল। তার এই বন্ধুরাই ভ্যানটাকে আমাদের শহরের লোকেদের ক্রোধ আক্রমণ থেকে রক্ষা করত। রামানির স্বপ্ন ভঙ্গের ব্যথা চেয়ে দেখার যন্ত্রণা থেকে বাঁচানোর জন্য আমি ঘটনাস্থল ত্যাগ করে সরে গিয়েছিলাম। তবে অন্যদের মুখে শুনেছিলাম যে রামানির মাথার চুল তেল মাখানো ছিল এবং পরনে ছিল মাড় দেয়া পরিচ্ছন্ন কাপড়। চোরের বিধবাটা রিকশা থেকে নামেনি, বরং কালো শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে রিকশায় বসেছিল, আর তার বাচ্চাগুলিকে আঁকড়ে ধরে ছিল যেন ওগুলো একেকটা শুষ্ক খড়কুটা।

কিছুক্ষণ পর ভ্যানের ভেতর থেকে তর্কাতর্কির শব্দ শোনা যায়, তারপর আরো জোরালো আওয়াজ আসতে থাকে। আর শেষমেশ বাহু বন্ধনী পরিহিত যুবকগুলো কী হচ্ছে তা দেখতে ভ্যানের ভিতরে প্রবেশ করে। এবং এরপরেই বেচারা রামানিকে তার মদ্যপ বন্ধুর দল চ্যাংদোলা করে ভ্যানের বাইরে বের করে দিল। তার চুলে দেয়া তেল তখন লেপ্টে ছিল তার মুখে আর মুখ থেকে রক্ত পড়ছিল। তখন আর তার কানের কাছে একটি করতল অর্ধবৃত্তাকারে ধরা ছিল না।

এবং তখন, সবাই আমাকে বলেছে, চোরের ডাইনি বিধবাটা রিকশা থেকে নড়েনি, যদিও ছেলেগুলো তার স্বামীকে রাস্তার ধুলোয় ছুড়ে মেরে ছিল।

হ্যাঁ, আমি জানি আমি একজন বৃদ্ধ মানুষ, আমার ধারণাগুলি বয়সের সঙ্গে ভাঁজ খেয়ে কুঁচকে গেছে। আজকাল অনেকে আমাকে নির্বীজন সম্পর্কে বলে। ঈশ্বর জানেন আসলে কোনটি প্রয়োজন। আর হয়তো বিধবাকে দোষ দেয়াটাও ভুল ছিল আমার—কেন নয়? হয়তো বৃদ্ধ মানুষের সমস্ত মতামত বাতিল করে দেয়া যেতে পারে এখন থেকে। আর যদি তাই হয়, তাহলে সবকিছু যেভাবে চলছে চলতে দাও। কিন্তু এই গল্পটা আমি বলছি তোমাকে এবং গল্পটা আমি এখনও শেষ করিনি।

ভ্যানের ঘটনাটির কিছুদিন পর রামানিকে দেখলাম তার রিকশাটি বিক্রি করে দিচ্ছে ওই মুসলমান বুড়ো বদমাশটার কাছে যে সাইকেল মেরামতের দোকানটি চালায়। রামানি যখন দেখলো আমি তাকিয়ে আছি, তখন সে আমার কাছে এগিয়ে আসে আর বলে, “বিদায়, মাস্টার সাহেব। আমি বোম্বে যাচ্ছি। যেখানে আমি শশী কাপুর অথবা অমিতাভ বচ্চনের চেয়েও বড় ফিল্ম-স্টার হয়ে যাব।”

এখানে আমার পাট ফুরিয়েছে, এই বলবে তো এখন?” রামানিকে প্রশ্ন করি আমি। “সম্ভবত তুমি একাই যাচ্ছ?”

রাম শক্ত হয়ে গিয়েছিল। চোরের বিধবাটা তাকে আগেই শিখিয়ে দিয়েছিল বড়দের সামনে নম্র না হতে।

“আমার স্ত্রী এবং সন্তানরাও যাচ্ছে,” রামানি বলে। সেটিই ছিল আমাদের শেষ আলাপ। সেদিনই তারা ট্রেনে করে আমাদের শহর ছেড়ে চলে যায়।

কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর আমি তার প্রথম চিঠিটা পেলাম। সেটা তার নিজের লেখা ছিল না, নিঃসন্দেহে। কারণ আমার অনেক আগেকার অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রাম খুব সামান্যই লিখতে পারতো। অর্থ খরচ করে একজন পেশাদার চিঠি-লেখককে দিয়ে চিঠিটা লিখিয়েছে সে। নিশ্চয়ই অনেকগুলো রুপি খরচ হয়েছে বেচারার। কারণ জীবনে সবকিছুর জন্য অর্থ খরচ করতে হয়, এবং বোম্বেতে সবকিছুর মূল্যই দ্বিগুণ। রাম কেন আমাকে চিঠি পাঠাত সে কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করো না। কিন্তু পাঠাতো। চিঠিগুলো আমার কাছে আছে এবং তোমাকে আমি আমার কথার সত্যতার প্রমাণ দিতে পারি। হয়তো বুড়ো মানুষের কিছু প্রয়োজনীয়তা রয়ে গেছে এখনো। অথবা রাম হয়তো জানতো যে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে তার খবর জানতে আগ্রহী।

যাইহোক, রামের চিঠিগুলিতে ভরা থাকত তার নতুন ক্যারিয়ারের কথা। চিঠিগুলো আমাকে জানিয়েছে বোম্বের লোকজন কীভাবে একবারেই আবিষ্কার করে ফেলেছে রামের প্রতিভাকে। একটি বড় স্টুডিওর একটি তার অভিনয় দক্ষতার পরীক্ষা নিয়েছিল। তারা রামানিকে তারকা হবার জন্য প্রস্তুত করছে। রামানি এখন শীর্ষস্থানীয় মহিলা আর্টিস্টদের সঙ্গে জুহু সমুদ্র সৈকতে সানএনস্যান্ড হোটেলে সময় কাটায়। পালি হিলে সে একটি বড় বাড়ি কিনেছে, যে বাড়িটি ডুপ্লেক্স ডিজাইনে নির্মিত এবং তাকে চলচ্চিত্র ভক্তদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সেই বাড়ির নির্মাণ কৌশলে সর্বাধুনিক সুরক্ষা সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত আছে। চোরের বিধবাটা ভালো আছে, সুখে আছে এবং মোটা হচ্ছে। রাম লিখেছে তার জীবন এখন আলো আর সাফল্যে এবং প্রশ্নাতীতভাবেই মদিরায়পরিপূর্ণ।

চিঠিগুলো বিস্ময়কর। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কিন্তু যখনই আমি সেগুলি পড়ি, এবং এখনো আমি মাঝেমাঝে ওগুলো পড়ি, আমার কেবল রামের সেই অভিব্যক্তিময় মুখটি মনে পড়ে যায়, যা তার মুখের পর্দায় ফুটে উঠেছিল রেডিও উপহার পাওয়া সংক্রান্ত সত্যটি জানার আগের দিন। তার সেই ব্যাপক উন্মাদনাময় শক্তি যা সে ঢেলে দিয়েছিলেন বাস্তবতাকে জাদুতে রূপান্তরিত করতে, তার দৃঢ় বিশ্বাসভরা অভিনয়ের মাধ্যমে, তার সেই অর্ধবৃত্তকার একটি করতল আর কানের মধ্যবর্তী মিহি উষ্ণ বাতাসকে ব্যবহার করে।

সালমান রুশদি
পুরো নাম আহমেদ সালমান রুশদি। ১৯৪৭ সালের ১৯শে জুন ভারতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যে যান এবং পরবর্তীতে ইতিহাসে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ব্রিটিশ ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক সালমান রুশদি বর্তমানে বাস করেন আমেরিকার নিউইয়র্কে।
প্রথম প্রকাশিত বই “গ্রিমাস” খুব একটা সাফল্য পায়নি। দ্বিতীয় বই “মিডনাইটস চিলড্রেন” প্রকাশিত হয় পাঁচ বছর পর। বইটি বুকার পুরষ্কার লাভ করে ১৯৮১ সালে। তৃতীয় বই “শেইম” প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় বহুল আলোচিত ও সমালোচিত পরাবাস্তববাদী উত্তরাধুনিক উপন্যাস “দ্য স্যাটানিক ভার্সেস,” যা তার প্রাণনাশের হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ইরানের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করেছিল এই উপন্যাস লেখার কারণে। ২০১০ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয় “রুকা অ্যান্ড দ্য ফায়ার অফ লাইফ” নামের আরেকটি উপন্যাস। একই বছরে তিনি আত্মজীবনী রচনা শুরু করেছেন বলে ঘোষণা দেন।

১২ আগস্ট ২০২২, নিউইয়র্কে ভাষণ দেওয়ার সময় লেখক সালমান রুশদি লেবাননি বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিক হাদি মাতার কর্তৃক অতর্কিত হামলার শিকার হন।

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *