বিদ্রোহী কে?// মূলঃ আলব্যার কাম্যু // অনুবাদঃ রাকিবুল আলম

বিদ্রোহী কে? বিদ্রোহী এমন একজন যে ‘না’ বলতে জানে! কিন্তু তার এই না বলার মাঝে কোন ত্যাগ করবার ভঙ্গি থাকে না। সেইসাথে বিদ্রোহ ঘোষণার একদম শুরুর মুহূর্ত থেকেই বিদ্রোহী একইভাবে ‘হ্যাঁ’ বলতেও সক্ষম। ‘বিদ্রোহী’ তো এমন একজন যে জীবনভর নীরবে দাসের মতো ঘাড় গুজে প্রভুর আদেশ পালন করে যায়, আর আচমকা একদিন সিদ্ধান্ত নেয় যে— “না! এভাবে আর নয়!” কিন্তু একজন বিদ্রোহী এই ‘না’ বলার মধ্য দিয়ে আসলে কি বোঝাতে চায়?  


উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সে বোঝাতে চায় যে “এই দাসত্ব অনেকদিন হলো চলে এসেছে”, “অনেকদিন ধরে চলে এসেছে বটে, কিন্তু এখন আর নয়!”; পাশাপাশি সে এটাও বোঝাতে চায় যে সব কিছুরই একটা সর্বশেষ সহনীয় মাত্রা রয়েছে যে সীমানার অতিক্রান্ত হলে,বাকিটুকু অসহনীয়। অন্যভাবে বললে, একজন বিদ্রোহীর প্রতিটি ‘না’-ই আসলে একটি করে অনতিক্রম্য সীমারেখা টানে। একজন বিদ্রোহীর অনুভবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কেউ না কেউ সেই স্বাভাবিকতার সীমানা অতিক্রম করে অতি বাড়াবাড়ি করছে; এই অতিক্রমকারী নিজের/নিজেদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে অপরের অধিকারকে ক্রমশ হরণ করছে। ‘বিদ্রোহী’-র অভিযাত্রা তাই সূচিত হয়, প্রথমত, এই অসহনীয় কর্তৃত্বকে চূড়ান্ত অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে; সেইসাথে এক ধরনের ‘অস্পষ্ট’ কিন্তু তীব্র বিশ্বাসের ওপরে দাঁড়িয়ে যে— “তারও অধিকার আছে…”। 

কোথাও না কোথাও কোন না কোনোভাবে সে যে আসলেই ‘সঠিক’ এই অনুভব ছাড়া বিদ্রোহীর জন্মই হতে পারে না। দাস থেকে বিদ্রোহী হয়ে উঠবার এই প্রক্রিয়ায় তাই একইসাথে তাকে সমান্তরালে ‘না’ এবং ‘হ্যাঁ’ বলে যেতে হয়। সব কিছুরই যে একটি সীমানা আছে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিতভাবেই ‘হ্যাঁ’ বলে। সীমানা অতিক্রমের সমস্ত প্রবণতাকে সে সন্দেহ করতে থাকে এবং আপ্রাণ চায় কিছু কিছু বিষয় যেন অবশ্যই সুনির্দিষ্ট সীমারেখার মাঝেই সর্বদা সুরক্ষিত থাকে। প্রায় একগুঁয়ের মতো করে সে দেখায় যে, কিছু বিষয় আলাদাভাবেই মূল্যবান এবং এর মূল্য অবশ্যই বিশেষ যত্ন নিয়েই চুকাতে হবে আমাদের। নিশ্চিতভাবেই একজন বিদ্রোহী এমন এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি নিজেকে আবিষ্কার করে যেখানে তাকে প্রাণপণে সহ্যসীমার ওপারের সবকিছুকে ‘না’ বলার চূড়ান্ত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিজেকে সক্রিয় রাখতে হয়।   

তাই বিদ্রোহের প্রতিটি পদক্ষেপেই একজন বিদ্রোহী একই সাথে দুটো ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি দ্বারা তাড়িত হয়। একদিকে অধিকার লঙ্ঘনের সমস্ত প্রচেষ্টার প্রতি চূড়ান্ত ‘না’ বলা জারি রাখা এবং অন্যদিকে নিজের বিশেষ কিছু অধিকারের ব্যাপারে পরিপূর্ণ ইতিবাচক আস্থা রাখা বা অন্যভাবে বললে, ক্রমশ ‘হ্যাঁ’ বলে যেতে থাকা। এভাবে নিজের ভেতরে সে একটি মূল্যবোধ তৈরি করে যা মিথ্যা থেকে অনেক দূরে, এবং এই মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখতে সে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে রাজি থাকে।  

এই পর্যায়ে আসার আগ পর্যন্ত অন্তত সে তো নীরব ছিল; নিঃশব্দে হতাশার সাথে মেনে নিয়েছিল তার চারপাশের অনুচিত এবং অসহ্যকর সকল ব্যবস্থাকে। এভাবে নীরব থেকে সে যেন বোঝাতে চায় তার ‘নিজস্ব’ কোন মতামত নেই, নেই কোন প্রত্যাশা; বরং সত্যিই কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে কোন বিকল্পের আশাই করেনি দীর্ঘদিন। ‘হতাশা’ এবং ‘অ্যাবসার্ডের’ মাঝে মিলের জায়গাটাই এখানে যে দুটো ক্ষেত্রেই সাধারণভাবে সবকিছুর ব্যাপারেই কিছু অতিসরলীকৃত মতামত কিংবা প্রত্যাশা থাকে কিন্তু কোন কিছুর ব্যাপারেই সুনির্দিষ্ট কোন বাঁধাধরা ভাবাবেগ থাকে না। এই ভঙ্গি নীরবতার চেয়ে ভালো করে আর কোন কিছুই  কি ব্যক্ত করতে পারে? কিন্তু যেই মুহূর্তে বিদ্রোহী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এই নীরবতাকে ভেঙে চুরমার করে দেবার (যদিও সে শুধু ‘না’-ই বলে); সেই মুহূর্ত থেকে জন্ম হয় তার সুনির্দিষ্ট পরিবর্তনের প্রত্যাশার এবং দাসের মতো আর মেনে না নিয়ে বরং সতর্কভাবে বেছে নেবার তীক্ষ্ণ বোধশক্তির। 

ব্যুৎপত্তিগতভাবেও ‘বিদ্রোহী’ মানেই ‘সম্পূর্ণরূপে ঘুরে দাঁড়ানো’ (to turnabout)। এতদিন যে প্রভুর চাবুকের আঘাতে আঘাতে অন্ধের মতো কাজ করে গেছে, আচমকা সে মাথা উঁচু করে ঘুরে দাঁড়ায় এবং নিজেরই মুখোমুখি হয়। অবাঞ্ছিতকে ছুঁড়ে ফেলে, সে তার প্রকৃত প্রত্যাশার দিকে হাত বাড়ায়। সকল মূল্যবোধের মধ্যে বিদ্রোহের বীজ থাকে না, কিন্তু সকল বিদ্রোহের অন্তরে গোপনে নানারকম নীরব মূল্যবোধ লালিত থাকে। কিন্তু বিদ্রোহ কি সত্যি সত্যি নিছক মূল্যবোধেরই প্রশ্ন?

প্রতিটি বিদ্রোহই কোন না কোন চেতনার জন্ম দেয়, সেটি যে সবসময় খুব গোছানো বা স্পষ্ট হবে এমন নয়। এ এমন এক চেতনা যা এপিফ্যানির মতো আকস্মিক! যে চেতনা আচমকা এসে হতচকিত করে এবং বিদ্রোহীর মনে (মুহূর্তের জন্যে হলেও) এই বিশ্বাস দেয় যে প্রতিটি মানুষের মাঝে (স্বভাবতই তার মাঝেও) নিজের চেয়ে বৃহত্তর কিছু আছে, যার সাথে সে নিজেকে একীভূত করতে সক্ষম।

বিদ্রোহের ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্তও এই একাকার হবার সম্ভাবনার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিদ্রোহী অজ্ঞ এবং অনভিজ্ঞ থাকে। এতদিন ক্রীতদাসের মতো সে শুধু মুখ বুজে সকল আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছে। আগে অনেক তীব্র অবমাননাকর ও অপমানজনক আদেশও সে পালন করে গেছে নীরবে। এমন কি সে যে আদেশের বিরুদ্ধে শেষে এসে বিদ্রোহ করে বসলো তার তুলনায় আগে যেসব আদেশ তাকে পালন করে আসতে হয়েছে সেসব আরো বেশি নোংরা এবং অবমাননাকর ছিল। ভেতরে ভেতরে মন থেকে যতই প্রতিবাদ আসুক না কেন, এতদিন সে এসব মুখ বুজে স্থির থেকে কেবল সয়ে গিয়েছে। 

এতদিন সে শুধু মুহূর্তের স্বার্থটাকেই প্রাধান্য দিয়েছে নিজের চিরন্তন অধিকারকে জলাঞ্জলি দিয়ে। কিন্তু বিদ্রোহের আকস্মিক মুহূর্তে সকল ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় এক নিমিষেই—সর্বগ্রাসী তীব্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পরে। এই প্রতিক্রিয়া পশ্চাৎমুখীভাবে ধাবিত হতে থাকে অতীতে মুখ বুজে সয়ে যাওয়া সকল অন্যায় আদেশের দিকে এবং একের পর এক তাদের প্রত্যাখান করতে থাকে।  একজন দাস প্রথমবারের মতো নিজের আদেশদাতা প্রভুর একটি অন্যায় আদেশ তীব্র প্রত্যাখান করার মধ্য দিয়ে আসলে ‘দাস-প্রভুর’ এই প্রচলিত ধারণা-কাঠামোকে একইসাথে পুরোপুরি অস্বীকার করে। বিদ্রোহ তাকে পৌঁছিয়ে দেয় সেই চূড়ায় যেখানে সে নিছক অপছন্দ করা কিংবা মনে মনে অগ্রহণযোগ্য মনে করার মধ্য দিয়ে কখনই পৌঁছাতে পারতো না। এখন সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য টানা সীমারেখা সাহসের সাথে অতিক্রম করে নিজের সম-অধিকার দাবি করে বসে!

যা ছিল এক সময় কেবলই বিদ্রোহ, এখন তা বিদ্রোহীর সমস্ত অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে—বিদ্রোহ আর বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এক এবং অবিচ্ছেদ্য। আত্মমর্যাদাকে সে সকল কিছুর ওপরে স্থান দেয় এবং এমনকি এই মর্যাদা স্বীয় জীবনের চেয়েও অধিক মূল্যবান বলে অনুধাবন করে একজন বিদ্রোহী। এটি হয়ে দাঁড়ায় তার চূড়ান্ত মঞ্জিল। কোন অন্যায়ের সাথে আর আপস না করার সিদ্ধান্তে উপনীত হবার সাথে সাথে বিদ্রোহী একটা “All or Nothing” মনোভাব পোষণ করা শুরু করতে থাকে (কেননা এটি অবিকল্প)। এভাবেই জাগে বিদ্রোহ, জাগে বিদ্রোহী-চেতনার চিরায়ত সত্তা।  

কিন্তু এখানেও আমাদের জন্য একটা বিষয় বিশেষ লক্ষণীয়। এই পর্যায়ে এসেও বিদ্রোহীর মনে ‘All’ এর ধারণাটা অনেকটাই অস্পষ্ট থাকে, বরং ‘Nothing’ এর কাছে যেকোন মুহূর্তে এই ‘All’ -কে সঁপে দেয়ার সম্ভাবনা বজায় থাকে বিদ্রোহীর তরফ থেকে। বিদ্রোহী নিজেই চায় এই ‘All’ হয়ে উঠতে — পুরোপুরি এই ‘All’ এর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে এবং একীভূত হয়ে যেতে যার ব্যাপারে সে হঠাৎ করেই সচেতন হয়ে উঠেছে এবং এর  মাধ্যমে সে তার ব্যক্তি সত্তার পরিচয় বিনির্মাণ করতে চায় এবং সেই বিনির্মাণের স্বীকৃতি দাবি করে। অন্যথায় সে বিকল্প হিসেবে শুধু ‘Nothing’-কেই ভাবতে পারে। অন্যভাবে দেখলে, এই ‘Nothing’ এর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা মানে যে শক্তি তাকে দাস বানিয়ে রেখেছে সেই একই শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করা। চূড়ান্ত বিচারে, এমনকি সে সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে মৃত্যুকেও বেছে নিতে প্রস্তুত থাকে (যা কিনা তার চূড়ান্ত পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে) যদি কিনা তার চূড়ান্ত মঞ্জিল ‘স্বাধীনতা’ থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়– কেননা  “ Better to die on one’s feet than to live on one’s knees”— দাসত্বের জীবনের চেয়ে  মুক্তিমুখীন মৃত্যুই শ্রেয়।      

এই বিষয়ে শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের অভিমত এই যে, এমন মূল্যবোধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষকে নিয়ে যায় তথ্য থেকে অধিকারের দিকে, বাঞ্ছিত থেকে বাঞ্ছনীয়র দিকে। নিছক ‘তথ্য’ আকারে যা এতদিন হাজির ছিল তা ‘অধিকারে’ রূপান্তরের এই প্রক্রিয়াটিই বিদ্রোহ। এরকমই আরেকটি প্রক্রিয়া হলো— ‘কেমন হওয়া উচিত’ থেকে ‘আমি ঠিক কীভাবে পেতে চাই’ কোন কিছুকে, সেই পরিবর্তন। সর্বোপরি, সামগ্রিক মঙ্গলের কাছে ব্যক্তির ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তার আত্মসমর্পণ। “All or Nothing” এই মনোভঙ্গির আকস্মিক আবির্ভাব প্রচলিত মতবাদকে অস্বীকার করে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে, বিদ্রোহ যদিও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী অনুভূতি দ্বারা জারিত একটি ফেনোমেনন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ এই ‘একক ব্যক্তিসত্তার’ অস্তিত্বকেই বরং প্রশ্নবিদ্ধ করে বসে!

যদি একজন বিদ্রোহী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয় বা তার বিদ্রোহের কারণে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয় তাহলে এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এটিই প্রমাণিত হয় যে, বিদ্রোহী মাত্রই বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে নিজের ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তাকে জলাঞ্জলি দিতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত —যে বৃহত্তর কল্যাণকে সে নিজের ব্যক্তি পরিণতির চেয়ে অনেক বেশি মাহাত্ম্যপূর্ণ বলে বিশ্বাস করে। নিজের অধিকার রক্ষার্থে যদি তাকে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হয় তাহলে এটাই বোঝায় যে, সে নিজের অধিকার রক্ষাকে নিজের বেঁচে থাকার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। সুতরাং তার সব সিদ্ধান্ত বিশেষ এক মূল্যবোধ দ্বারা তাড়িত, যদিও ঐ মূল্যবোধসমূহ তখন পর্যন্ত তার কাছে পুরোপুরি সুনির্দিষ্ট নয় কিন্তু সে নিশ্চিতভাবেই জানে যে ঐ মূল্যবোধসমূহ তার নিজের এবং সকল মানব সন্তানের জন্য অভিন্ন। 

ফলত: আমরা দেখতে পাই প্রত্যেকটি বিদ্রোহের মধ্যেই লুকায়িত থাকে এমন একটি কারণ যেখানে ব্যক্তি নিজেকে ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তা থেকে অতিক্রম করাতে সক্ষম হয় এবং চুপচাপ বসে থাকার বদলে সেই মূল্যবোধের তাড়নাতেই সে বদলে দেবার কাজ শুরু করবার একটি যথার্থ কারণ খুঁজে পায় । এখানে এটি উল্লেখ করা খুবই জরুরি, এই যে বিদ্রোহের প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা দেখলাম যে, এক ধরনের মূল্যবোধ আগে থেকেই থাকে যার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের সূচনা ঘটে তা বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক দার্শনিকদের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক দার্শনিকরা দাবি করেছিলেন যে ভ্যালুজ বা মূল্যবোধ মানুষ কেবল তখনই অর্জন করে যখন সে কোন কাজ সম্পূর্ণ করে, তার আগে নয়। এক্ষেত্রে কিন্তু আমরা তার বিপরীত চিত্রই দেখতে পাই।

বিদ্রোহের এই প্রক্রিয়াটিকে যদি আমরা একটুখানি মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করি তাহলে এক ধরনের সন্দেহের অবকাশ থাকে তা হলো এই যে, বর্তমান সময়ের প্রচলিত চিন্তা-ভাবনার বিপরীত্‌ হয়তবা (গ্রিকরা যেমন বিশ্বাস করতো তেমন) একটি চিরন্তন মানবিক প্রকৃতি সত্যিই বিরাজমান। যদি নিজের মধ্যে চিরন্তন সেই সংরক্ষণযোগ্য কিছু নাই থাকে, তাহলে আর বিদ্রোহ কেন? কী দরকার? একজন ক্রীতদাস দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মধ্য দিয়ে শুধু নিজের শৃঙ্খলের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ায় না বরং সে এই উপসংহারে পৌঁছায় যে অন্যায় আদেশগুলো তার ভেতরের কোন একটি সংরক্ষণযোগ্য অধিকারকে বিঘ্নিত করছে যা কোনোভাবেই লঙ্ঘনযোগ্য নয়, এমনকি যে তার শত্রু তার ক্ষেত্রেও নয়, এমনকি যে অধিকার লঙ্ঘন করছে সেই অত্যাচারীর ক্ষেত্রেও এমনটি হওয়া উচিত নয়। ফলে ব্যক্তি নিজে বিদ্রোহ করলেও, সে তা করে সমগ্রের পক্ষেই।

দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে এই অবস্থানকে যৌক্তিক প্রমাণ করা যায়। প্রথমত, আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি যেকোনো বিদ্রোহই আসলে ব্যক্তিস্বার্থবাদী কোন কাজ নয় কিছুতেই। অবশ্য নিশ্চিতভাবেই এর কিছু ব্যক্তিগত মোটিভ থাকবেই। কিন্তু কেউ নিশ্চিতভাবেই একইসঙ্গে মিথ্যা এবং শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ফেলতে পারে। বিষয় হলো এই যে একজন বিদ্রোহী বিদ্রোহের মুহূর্তে আর যাই হোক না কেন নিজের জন্য কোন কিছু সঞ্চয় করতে চায় না বরং নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে দিতে চায়, সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিতে চায়, এমনকি তার নিজের জীবনের ঝুঁকিও। সে দাবি করে তার আত্মসম্মানের অধিকার। কিন্তু সেই আত্মসম্মানের অধিকারের দাবিটি সে কেবল এককভাবে নিজের জন্য করে না বরং তার মধ্যে নিহিত থাকে প্রত্যেক মানুষের আত্মসম্মানের অধিকারের দাবিটি।

এছাড়াও আমরা আরও দেখতে পাই যে বিদ্রোহের জন্ম শুধু যে ‘অত্যাচারিত’, শুধু তার মাধ্যমেই সব সময় ঘটে এমনটি নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতে পারে অন্য কাউকে অত্যাচারিত হতে দেখার মধ্য দিয়ে। এই ক্ষেত্রে এক ধরনের সহানুভূতির প্রশ্ন চলে আসে।  বিদ্রোহী অত্যাচারিতের সাথে নিজেকে মিলিয়ে ফেলতে পারে।  এবং এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এই মিলনের জায়গাটি সাইকোলজিকাল বা মনস্তাত্ত্বিক নয় যেখানে কল্পনায় একজন ব্যক্তি অন্য একজন অত্যাচারিত ব্যক্তির সাথে নিজেকে মিলাতে চেষ্টা করে। বরং এক্ষেত্রে ঠিক তার বিপরীতটি ঘটে। যে অন্যায় প্রায়শই আমরা নিজেদের ক্ষেত্রে মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলাম সেই একই মাত্রার অন্যায় অন্য কারো সাথে আমাদের চোখের সামনে হতে দেখলে আমরা বিদ্রোহ করে বসতে পারি। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হতে পারে সাইবেরিয়াতে নিজ সঙ্গীদেরকে বেদম পেটানো হচ্ছিলো এমনটা প্রত্যক্ষ করে রাশান বা রুশ সন্ত্রাসবাদীদের গণ-আত্মহত্যার ঘটনাটি। আরও মনে রাখতে হবে এটি শুধু একটি গোষ্ঠীগত সংহতির প্রশ্ন নয়। আশ্চর্যজনকভাবে এমনকি যাদেরকে আমরা শত্রু বলে প্রতিপন্ন করি তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ও আমাদের গভীর কোন স্থানে বিরক্তি উৎপাদন করে, আমাদের বিচলিত করে। এই প্রক্রিয়াটি এমন যে প্রতিনিয়তই আমাদের নিজেদের ভাগ্যচক্রের সাথে অপরের ভাগ্যচক্রকে মিলিয়ে দেখতে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই পক্ষ নির্ধারণ করতে হয়। সুতরাং ব্যক্তি মানুষ স্বয়ং যে মূল্যবোধকে প্রমাণ করতে চায় সে নিজে তার একক প্রতিমূর্তি হয়ে উঠতে পারে না। সমগ্র মানবতার সঙ্গেই তার আপোস করবার নিতান্ত দরকার হয়ে পড়ে। একজন মানুষ অপরের সাথে নিজেকে একাত্ম ঘোষণা করে এবং নিজেকে অতিক্রম করে যায়। এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে সমগ্র মানবজাতির সংহতির মৌলিক প্রশ্নটি আসলে মেটাফিজিক্যাল। তবে সেই আলাপে না ঢুকে কিছুক্ষণের জন্য আমরা বরং আমাদের আলাপ সীমাবদ্ধ রাখবো বিশেষ ধরনের সংহতির বিষয়ে যা কেবল শৃঙ্খলের মধ্যে জন্ম নেয়।

এক্ষেত্রে ম্যাক্স শেলার (জার্মান দার্শনিক) যেমন করে ক্ষোভের সংজ্ঞা এবং তার ভেতরে অন্তর্নিহিত নেতিবাচক মূল্যবোধের বর্ণনা করেছিলেন ঠিক একইভাবে আমরাও চেষ্টা করে দেখতে পারি বিদ্রোহের পেছনে ক্রিয়ারত মূল্যবোধসমূহের ইতিবাচকতার দিকে। 

সকল বিদ্রোহই প্রকৃতপক্ষে প্রতিশোধ আকাঙ্ক্ষার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। ক্ষোভ বা ঘৃণার সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে শেলার যথার্থভাবেই এর নাম দিয়েছিলেন ‘সেলফ ইনটক্সিকেশন’ বা স্বতঃপ্রমত্ততা। এ যেন দীর্ঘকালীন ক্ষমতাহীন একটি মুখবন্ধ পাত্র  থেকে কু-নিঃসরণ। বিপরীত দিকে, বিদ্রোহ এসে এই ক্ষমতাহীন মুখবন্ধ পাত্রের মুখটি একটানে খুলে ফেলে, ভেতরের সবটুকু ঘৃণা বাইরে বেরিয়ে আসে মুহূর্তেই। জমে থাকা দীর্ঘদিনের বদ্ধ জল পরিণত হয় তীব্র জলোচ্ছ্বাসে। শেলার নিজেও অবশ্য নিছক ‘ক্ষোভের’ নেতিবাচক দিকের ওপর জোর দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি নারী মনস্তত্ত্বের প্রসঙ্গ টেনে এনে দাবি করেছিলেন যে, যে-সব নারী ইচ্ছা এবং অধিকারের বাসনা দ্বারা অতি তাড়িত, তাদের ক্ষেত্রে এই ‘ক্ষোভ’ মনস্তত্ত্বে তীব্রভাবে শেকড় গেড়ে বসে। ক্ষোভের বিপরীতে আমরা যদি বিদ্রোহের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো যে বিদ্রোহের মধ্যে থাকে শক্তির প্রাচুর্য এবং সেই শক্তিকে কর্মে পরিণত করার অসামান্য সামর্থ্যের আধিক্য। শেলার এটাও ঠিকই বলেছিলেন যে, ক্ষোভ সবসময়ই হিংসার রঙে রঞ্জিত। একজন হিংসুক তার নিজের যা নেই তা অন্যের কাছে থাকা দেখেই কেবল হিংসা করে কিন্তু বিদ্রোহীর সাথে তার পার্থক্য এখানেই যে বিদ্রোহী যা তার ইতোমধ্যেই আছে তা রক্ষায় যুদ্ধে লিপ্ত। বিদ্রোহীর লক্ষ্য তো শুধু এটুকুই যে, যা তার নিজের বলে সে নিশ্চিত হয়েছ্‌ শুধু সেটুকুর স্বীকৃতি নিজের বলে আদায় করে নেয়া। এবং এই স্বীকৃতি আদায় অন্য সকল কিছুর চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে, ফলত বিদ্রোহের ক্ষেত্রে হিংসা প্রবণতা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। আত্মঅধিকারের স্বীকৃতি আদায়ের চেয়ে অধিক কোন কিছু তার আকাঙ্ক্ষার সীমানাতেই তো নেই— সে হিংসা করবে কি নিয়ে? তাই তথাকথিত বাস্তববাদ নয়, বরং ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের গঠনের ভিন্নতার কারণে, শেলারের মতে, নিছক ক্ষোভ বা ঘৃণা দিনশেষে সবসময়ই ক্রূর আশা কিংবা  নিতান্ত তিক্ততায় রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ক্ষোভ এবং বিদ্রোহ দুটোর ক্ষেত্রেই একটি আকাঙ্ক্ষা মিলে যায় আর সেই আকাঙ্ক্ষাটি হচ্ছে এমন কিছুর প্রত্যাশা যা ইতোমধ্যে ব্যক্তির আয়ত্তে নেই। ঘৃণা সবসময়ই শুরুতে নিজের প্রতি ঘৃণা। কিন্তু অন্যদিকে বিদ্রোহী তার প্রথম পদক্ষেপ থেকেই নিজেকে স্পর্শ করার অনুমতি অন্য কাউকে দেয় না। ভেতরের মূল্যবান একটি অংশকে সুরক্ষিত করায় সে সর্বদা সংগ্রামরত। প্রাথমিকভাবে সে কখনোই বিজয়ী হতে চেষ্টা করে না, কেবল অধিকার রক্ষা করতে ইচ্ছুক থাকে। 

চূড়ান্ত বিচারে, ক্ষোভ বা ঘৃণার ধর্মই এমন যে, সে যাকে ঈর্ষা করছে তার আশু বেদনার আভাস পেলেও এমনকি আগেভাগেই আনন্দ অনুভব করতে থাকে। নিৎসে এবং শেলার উভয়েই একটি চমৎকার উদাহরণ তুলে ধরেছেন সেই অংশ থেকে যেখানে টারটুলিয়ান পাঠকদের জানান দিচ্ছেন যে, রোমান সম্রাটদের নরকাগ্নিতে পুড়তে দেখে স্বর্গে যারা ‘ব্লেসড’ তারা কি তীব্র সুখটাই না অনুভব করেন! এমনকি এই জগতেও নিপাট ভদ্র মানুষেরা এই একই ধরনের আনন্দ পান যখন তারা কারও ফাঁসি হবার দৃশ্য দেখতে যান। কিন্তু একজন প্রকৃত বিদ্রোহী এর সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করেন। সে শুধু নিজের অধিকার এবং আত্মমর্যাদাটুকু সুরক্ষিত রেখেই তৃপ্ত। বিনিময়ে সে অপরের কোন অবমাননা হোক তা ঘুণাক্ষরেও প্রত্যাশা করে না। তার সামগ্রিক এই চাওয়াকে সম্মান দেয়া হলে এমনকি সে বেদনার সামনেও হাসিমুখে দাঁড়িয়ে যায়। 

এ কারণেই শেলার কেন যে ঘৃণা কিংবা ক্ষোভের সাথে বিদ্রোহের অনুভবকে গুলিয়ে ফেললেন তা বোঝা বেশ মুশকিলই বটে। 


মানবতাবাদের (যাকে তিনি বরাবরই মানবিক প্রেমের একটি অখ্রিষ্টীয় রূপ হিসেবে বিবেচনা করেছেন) অভ্যন্তরে লুকায়িত ক্ষোভ বা ঘৃণার যে সমালোচনা শেলার করে গিয়েছেন তা সম্ভবত কেবল প্রযোজ্য হতে পারে কিছু কিছু অনির্দিষ্ট ধরনের মানবতাবাদী আদর্শের কিংবা সন্ত্রাসবাদী কৌশলের ক্ষেত্রে। কিন্তু শেলারের এই অবস্থান ব্যক্তির নিজের বর্তমান পরিস্থিতির বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ প্রবণতা সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ভুল প্রমাণিত হয়–যেহেতু এই বিদ্রোহ আসলে ব্যক্তির নিজের আত্মমর্যাদা রক্ষার মধ্য দিয়ে সমগ্রের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠারই নামান্তর।   

শেলার মূলত যেটা বুঝাতে চান তা হলো, মানবতাবাদী অবস্থানের সাথে সবসময়ই জাগতিক পৃথিবীর প্রতি এক ধরনের ঘৃণার অনুভূতি অনুষঙ্গী হিসেবে থাকে।

সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে ভালোবাসার দায় এড়াতেই সমগ্র মানবতার প্রতি এক ধরনের ‘আপাত ভালবাসা’ মানবতাবাদীরা প্রকাশ করে থাকেন। এই অবস্থানটি কোন কোন ক্ষেত্রে সত্যিই বটে। এবং এটি আরো ভালো করে বোঝা যায় যখন আমরা টের পাই যে মানবতাবাদ সংক্রান্ত  শেলারের এই বোঝাপড়াগুলো বেন্থাম এবং রুশোর ধারণাসমূহ দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত। কিন্তু মনে রাখা ভালো যে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা সব সময় কেবল গাণিতিক যোগ-বিয়োগ করে পুরস্কার লাভের উদ্দেশ্যে কিংবা মানব চরিত্রের ব্যাপারে নিছক এক ধরনের তাত্ত্বিক বোঝাপড়া থেকেই জন্ম নেয় না।

উদাহরণস্বরূপ উপযোগবাদী এবং এমিলির গুরুদের বিরুদ্ধে গিয়ে দস্তয়ভস্কি তার আইভান কারমাজভের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহ থেকে অধিবাদী বিপ্লবের দিকে যাত্রাকে মূর্ত করে দেখিয়েছেন।

শেলার এই বিষয়টি বুঝেই তাই সংক্ষেপে লিখেছেনঃ “মানব ব্যতীত অন্য কিছুতে নষ্ট করার মতো যথেষ্ট ভালোবাসা পৃথিবীতে নেই।”

এই বক্তব্যকে সত্য ধরে নিলে আসলে যে হতাশার সৃষ্টি হয়, তা বরং ঘৃণা ব্যতীত অন্য কিছুরই জন্ম দেয়। প্রকৃতপক্ষে এটি কারমাজভের বিদ্রোহের নির্যাতিত চরিত্রটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। উল্টোদিকে ইভানের ঘটনা এই সত্য থেকেই উৎসারিত যে দুনিয়াতে ভালোবাসার আধিক্যই বরং বিরাজমান; যদিও সে ভালোবাসার কোন অভীষ্ট নেই। এই ধরনের ভালোবাসা না পায় কোন প্রকাশিত হবার উপযুক্ত জায়গা, এবং যেহেতু ‘ঈশ্বর’ ধারণাকে এক্ষেত্রে বাতিলের তালিকায় ফেলে দেয়া হয়েছে, ফলশ্রুতিতে এই ভালবাসা শেষতক মানুষের মাঝেই উদার এবং বিবেচনাহীনভাবে বিলিয়ে দেওয়ার পরিণতি লাভ করে।

তবে, এতক্ষণের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, কোন বিদ্রোহের ক্ষেত্রেই নিতান্তই আবেগহীনভাবে কেবল কোন বিমূর্ত ধারণাকে বা কোন নিস্ফলা দাবিকে অবলম্বন করা হয় না। খুবই জোর দিয়ে আমরা মানুষের অন্তর্নিহিত ঐ অংশকে আমলে নিতে জোর দাবি জানাই যে অংশকে কোন মতেই নিছক ‘ভাবনারাশি’ বলে চালিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এটি মানবসত্তার সেই অংশ যা তাকে বেঁচে থাকার তাড়না দেয়া ছাড়া আর বিশেষ কোন উদ্দেশ্যই রাখে না । কিন্তু এর মানে কি তাহলে এটাই যে ক্ষোভ বা ঘৃণা থেকে কোন বিদ্রোহই অনুপ্রাণিত হয় না? উত্তর হচ্ছে- ‘না’ এবং এই উত্তর এই কলিকালে খুব ভালোভাবেই আমাদের সকলের জানা। 

কিন্তু আমাদের অবশ্যই বিদ্রোহকে এর বহুমাত্রিক জায়গা থেকে বুঝতে হবে এবং এর সার্বিক প্রেক্ষাপট থেকে, যদিও সে প্রক্রিয়ায় বিদ্রোহের প্রচলিত ধারণাই হয় প্রতারিত। এই সার্বিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে বিদ্রোহ ক্ষোভকে অতিক্রম করে যায় বহুদূর। যখন উইদারিং হাইটস এর হিথক্লিফ বলে যে, সে তার প্রেমকে স্থান দেয় ঈশ্বরের ওপরে, প্রেমিকার সাথে আবারও একাত্ম হতে সে স্বেচ্ছায় নরকে যাবে; তখন সেসব বলার কারণ কেবল তার যৌবন আর অবমাননার স্মৃতিই নয় বরং এমন ভাবনা যা কিনা তার গোটা জীবনের শোষিত হবার অভিজ্ঞতা দ্বারাও প্রণোদিত। একই ধরনের অনুভূতি দ্বারা তাড়িত হয়ে একার্ট ধর্মদ্রোহীর মতো বলেছিল যে, যীশুহীন স্বর্গ অপেক্ষা বরং যীশুর সঙ্গে নরকবাস তার অধিকতর প্রিয়। এই হলো প্রেমের প্রকৃত সারবত্তা। এক্ষেত্রে তাই শেলারের ধারণার বিপরীতেই আমাদেরকে অবস্থান নিয়ে এ কথাই বলতে হচ্ছে যে, বিদ্রোহের পাটাতনে ইতিবাচক আবেগের অতি প্রতুলতা থাকে না; এবং স্বভাবতই বিদ্রোহ এবং ক্ষোভ/ঘৃণাকে একভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই।

বিদ্রোহ, আপাতদৃষ্টিতে যদিও নেতিবাচক (যেহেতু সে নাকচ করতে করতেই এগোতে থাকে), কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে এটি প্রবলভাবেই ইতিবাচক কেননা এটি মানুষের সেই অসামান্য অংশকেই সামনে টেনে নিয়ে আসে যা অবশ্যই সুরক্ষিত থাকা উচিত।

কিন্তু, যদি আমরা আলোচনাটিকে সংক্ষিপ্ত করে নিয়ে আসতে চাই, তাহলে প্রশ্ন জাগে–বিদ্রোহ এবং সেই বিদ্রোহ যে মূল্যবোধকে প্রকাশ করে, এই দুটি বিষয় কি সর্বদা আপেক্ষিক নয়? সময় এবং সভ্যতার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিদ্রোহের কারণগুলো স্বভাবতই ক্রমশ বদলাতে থাকে। একজন নিম্নবর্গীয় হিন্দু , একজন ইনকা যোদ্ধা, একজন মধ্য-আফ্রিকার অধিবাসী কিংবা একদম শুরুর দিকের খ্রিষ্টীয় কমিউনিটির কোন এক সদস্যের বিদ্রোহের ধারণা নিশ্চয়ই একে অপরের থেকে খুবই ভিন্ন ধরনের। 

যথেষ্ট নিশ্চয়তা সহকারে আমরা এমনটাও দাবি করতে পারি যে, ওপরে উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতে বিদ্রোহের ধারণার সত্যিকারের সুনির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই। যাইহোক, একজন গ্রিক দাস, একজন সার্ফ, রেনেসাঁর সময়ের একজন নেতা, রিজেন্সি পর্বের একজন পার্শিয়ান বুর্জোয়া, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের একজন রুশ বুদ্ধিজীবী এবং বর্তমানের একজন খেটে খাওয়া মজুরের বিদ্রোহের কারণগুলো নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন। তবে এদের সবাই একটি মতে অভিন্ন আর তা হল–বিদ্রোহ মাত্রই বৈধ!

অন্যভাবে বললে, বিদ্রোহের ডিসকোর্স শুধু পশ্চিমা চিন্তার ঘেরাটোপেই একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোবদ্ধ ধারণা আকারে হাজির হয়। এমনকি শেলারের সাথে মিল রেখে এ কথাও জোর দিয়ে বলা যায় যে, যে সমাজগুলোতে বৈষম্য খুব বেশি যেমন হিন্দু বর্ণ ব্যবস্থা কিংবা যেখানে নিরঙ্কুশ সাম্য রয়েছে (যেমন কিছু অতি প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা) সেখানে বিদ্রোহের চেতনা নিজেকে প্রকাশের খুব কম উপায়ই খুঁজে নিতে সক্ষম হয়। বিদ্রোহের চেতনা কেবল এমন একটি সমাজে নিজেকে প্রকাশিত করতে পারে যেখানে বাস্তব বৈষম্যগুলোকে লুকিয়ে রাখার স্বার্থে এক ধরনের আপাত সমতাকে তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে রাখা হয়। অতএব, আমাদের নিজস্ব পশ্চিমা সমাজের বাইরে বিদ্রোহ নামক সমস্যার কোন অর্থই নেই। 

যদি না পূর্ববর্তী আলোচনার ধারাবাহিকতা আমাদেরকে ইতোমধ্যেই সতর্ক করে না দিতো, তবে যে কেউ এমনকি এ কথা দাবি করতে প্রলুব্ধ হতেই পারতো যে, বিদ্রোহ মূলত ব্যক্তিবাদ বিকাশের সাথে সম্পর্কিত একটি প্রপঞ্চ। প্রমাণের ওপর ভর করে, শেলারের বক্তব্য থেকে এই উপসংহারই টানা যায় যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা তত্ত্বের বদৌলতে আমাদের সমাজের ভেতরে মনুষ্য সংক্রান্ত ধারণার বিষয়ে মানুষের মধ্যে ক্রমবিকাশমান সচেতনতা রয়েছে আর তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে অসন্তোষ, যার পেছনে কাজ করছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা তত্ত্বের প্রয়োগ। স্বাধীনতা বিষয়ে সচেতনতার সাথে মিল রেখে সত্যিকারের স্বাধীনতার পরিমাণ বাড়েনি। এ থেকে আমরা কেবল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, বিদ্রোহ হচ্ছে নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন শিক্ষিত ব্যক্তির কাজ। কিন্তু এমন কোন প্রমাণাদি নেই যা থেকে আমরা এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, এটা কেবলই ব্যক্তির নিজস্ব অধিকারের বিষয়। কেননা সংহতি বোধের যে বিষয়টি ইতোমধ্যেই তুলে ধরা হয়েছে তা থেকে এমনটাই মনে হয় যে মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মসচেতনতা এখনো এক রকমের বিপন্ন অবস্থা্তেই রয়েছে। 

প্রকৃতপক্ষে, ইনকা আর অন্ত্যজদের ক্ষেত্রে বিদ্রোহের সমস্যা কখনো ওঠে না, কারণ সমস্যা উত্থাপনের আগেই তাদের ঐতিহ্যের দ্বারা সেই সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। কারণ সেই ঐতিহ্য হলো ধর্মীয়। ধর্মাশ্রিত জগতে বিদ্রোহের সমস্যা উত্থাপিত হয় না, কারণ তেমন একটা জগতে প্রকৃত কোন সমস্যাই খুঁজে পাওয়া যায় না–প্রশ্নের সাথে সাথেই সব উত্তর মেলে। অধিবিদ্যার স্থান নেয় মিথ। সেখানে আর কোন প্রশ্ন থাকে না, থাকে শুধু শাশ্বত উত্তর আর ব্যাখ্যা। মানুষের পক্ষ থেকে ধর্মাশ্রয়ীতাকে মেনে নেয়ার আগে, অথবা এর থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে আত্ম-অন্বেষণ ও বিদ্রোহের একটি পর্যায় থাকে। সেই ব্যক্তি বিদ্রোহী যে কিনা সেক্রেডকে গ্রহণ কিংবা বর্জনের বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত অবস্থায় রয়েছে আর যে যুক্তিসংগত একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ। সেই মুহূর্ত থেকে প্রতিটি প্রশ্ন, প্রতিটি শব্দ আসলে বিদ্রোহ আর উল্টোদিকে একটা সেক্রেড জগতে প্রতিটি শব্দই স্বর্গীয়। আর পুরো বিষয়টাকে এভাবে দেখলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানুষের চিন্তার জগতে কেবল দু’ধরণের জগতের অস্তিত্ব রয়েছেঃ একটা হলো সেক্রেড জগৎ (খ্রিষ্টীয় পরিভাষায় যার নাম হল স্বর্গীয় জগৎ) আর একটা হল বিদ্রোহের জগৎ। এক জগতের লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার মানেই হলো অপর জগৎটির উপস্থিতি, যদিও সেই জগতের উপস্থিতি বেশ বিশৃঙ্খল উপায়েও ঘটতে পারে। এই পর্যায়ে এসেও আমরা আবারও সেই “All or Nothing” এর মতন অবস্থাটিকেই পুনঃআবিষ্কার করলাম। বিদ্রোহ বিষয়ক বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গটি যে বাস্তবতা থেকে উদ্‌গত তা হলো এই যে বর্তমান সময়ে পুরো সমাজই সেক্রেডকে বাতিল করে দিতে চাইছে। ইতিহাসের এমন এক মুহূর্তে আমাদের বসবাস যা কিনা সম্পূর্ণভাবে ‘পবিত্রতা’ বিবর্জিত। বিদ্রোহ কোনোভাবেই মনুষ্য অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণটা নয়। কিন্তু বর্তমানের ইতিহাস আমাদেরকে এই কথা বলতেই বাধ্য করায় যে মানুষের জীবনের নানা মূল ডাইমেনশনগুলোর মধ্যে বিদ্রোহ একটি। এ আমাদের ঐতিহাসিক বাস্তবতা। যদি না আমরা বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত না নিয়ে থাকি তাহলে এই বাস্তবতার ভেতরে থেকেই আমাদের নীতিনৈতিকতাগুলো খুঁজে পাওয়া দরকার। ধর্মের বাইরের জগতে, এর পরম নীতি-নৈতিকতার বাইরে কি আচরণবিধির নীতিমালা খুঁজে পাওয়া সম্ভব? বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে এই প্রশ্নটিই আসলে উত্থাপিত হয়।                 

আমরা ইতোমধ্যেই সেই বিভ্রান্ত মূল্যবোধগুলোর উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি যা প্রাথমিক বিদ্রোহের দ্বারা সূচিত হয়। এখন আমাদেরকে অবশ্যই সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে এই একই মূল্যবোধগুলো বর্তমানের বিভিন্ন বিদ্রোহী চিন্তা-ভাবনা এবং কর্মের মধ্যে উপস্থিত আছে নাকি নেই ; এবং যদি থেকে থাকে তাহলে আমাদের অবশ্যই তাদের বিষয়বস্তু নির্দিষ্টরূপে চিহ্নিত করতে হবে। তবে আলোচনা সেদিকে বাড়ানোর আগে আমাদের পুনরায় স্মরণ করা উচিত যে, এই সমস্ত মূল্যবোধ বিদ্রোহের ভিত্তির ওপরেই কেবল প্রতিষ্ঠিত। মানুষের সংহতি বিদ্রোহের ওপর প্রতিষ্ঠিত; এবং বিদ্রোহ, তার পালাক্রমে, কেবল এই সংহতির মধ্য দিয়েই তার ন্যায্যতার দাবি তুলতে পারে। সুতরাং এ কথা বলার সম্পূর্ণ অধিকার আমাদের রয়েছে যে, যেকোনো বিদ্রোহ যা এই সংহতিকে অস্বীকার বা ধ্বংস করার দাবি করে, তা সেই মুহূর্তেই ‘বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত হওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলে এবং প্রকৃতপক্ষে হত্যার সম্মতি উৎপাদনমূলক হয়ে ওঠে। একইভাবে, ধর্মের ক্ষেত্র ব্যতীত, কেবল বিদ্রোহের স্তরেই জীবন্ত আকারে হাজির হয় এই সংহতি। আর এভাবেই বিপ্লবী ভাবনার প্রকৃত নাটকের পর্দার উন্মোচন ঘটে। নিতান্ত অস্তিত্বের স্বার্থেই, মানুষকে অবশ্যই বিদ্রোহ করতে হবে, কিন্তু বিদ্রোহকে অবশ্যই তার নিজের মধ্যে আবিষ্কৃত স্বাভাবিক সীমানাকে সম্মান করতে হবে। কেননা এটি এমন একটি সীমা যেখানে মনের মিলন হয় এবং এই মিলনের ফলেই মানুষের সম্মিলিত অস্তিত্বের সূচনা হয়। বিদ্রোহ তাই বিস্মৃতিতে পরিণত হওয়ার প্রশ্নই নয়, এটি একটি সার্বক্ষণিক উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা পূর্ণ তরতাজা অবস্থা। প্রতিটি বিদ্রোহই স্বতন্ত্র আর তাই প্রত্যেকটি বিদ্রোহের পর্যায়ক্রমিক কার্যক্রম এবং ফলাফল সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে আমাদেরকে আলাদাভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সেই বিশেষ বিদ্রোহটি তার আদি উচ্চ আদর্শমার্গ থেকে কোন অবহেলা বা বোকামির মাধ্যমে বিচ্যুত হয়ে অত্যাচার বা দাসত্বের চোরাবালিতে ডুবে গিয়েছে নাকি সেই আদি আদর্শেই অটল এবং অবিচল রয়েছে। 

এখন, সংক্ষিপ্তভাবে আমরা এভাবে বলতে পারি যে, বিদ্রোহের চেতনা কেবল সেই মনস্তত্ত্বেই জন্ম নিতে পারে যেই মনে আগে থেকেই জগতের অসাড়তা, অনুর্বরতা এবং অর্থহীন আচারের প্রতি অনাস্থা ছিল। অ্যাবসার্ডের দৃষ্টিকোণ থেকে, দুঃখ-কষ্ট নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু যেই মাত্র বিদ্রোহের জন্ম হয়, সেই মুহূর্তেই দুঃখ-কষ্ট-যাতনা মানব প্রজাতির একটি সামষ্টিক ব্যাপার হিসেবে আবির্ভূত হয়। সুতরাং একজন অদূর ভবিষ্যতের বিদ্রোহীর প্রথম প্রগতিশীল পদক্ষেপ হবে এই সত্যটি উপলব্ধি করা যে, তার ব্যক্তিগত পরিসরের যে অস্থিরতা এবং অসামঞ্জস্যতা দেখে সে ব্যক্তিগতভাবে বিচলিত বোধ করছে, তা আসলে ব্যক্তিগত নয়, বরং সার্বিক ও সামষ্টিক! এবং জীবনযাপনে ব্যক্তিমানুষ যাতনা বোধ করে কারণ সে এই সমষ্টির বোধ হারিয়ে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে পরিণত করে নিজেকে। ব্যক্তির জন্য যা কেবল একটি অসুখ, সামষ্টিক পর্যায়ে তাই প্লেগে পরিণত হয়। প্রতিদিনকার জীবনযাপনের এই কঠোর পরীক্ষার মধ্যে ‘বিদ্রোহ’ আসলে সেই ভূমিকা পালন করে যা যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘Cogito’ পালন করেছিল। দুটো ক্ষেত্রেই তারা সামষ্টিক প্রমাণের প্রাথমিক এবং অনস্বীকার্য অংশ! এবং এই প্রথম অংশ উপলব্ধি করেই ব্যক্তি তার বিচ্ছিন্নতার খোলস থেকে বের হয়ে সমষ্টির দিকে এগিয়ে যেতে প্রলুদ্ধ বোধ করে। 

প্রথমবারের মতো সে নিজের মূল্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয়ে ওঠে সমগ্রের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে—“আমি বিদ্রোহী, তাই, ‘আমরা’ অস্তিত্বশীল!”

*ক্রান্তি সাহিত্য পত্রিকার মে ২০২৪ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত।

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *