সীমানা টানা আকাশ// মূল: জেমস থার্বারের “দ্যা কার্ব ইন দ্যা স্কাই”// অনুবাদ : রাকিবুল ইসলাম

চার্লি ডেসলার যখন ঘোষণা দিল যে সে ডরোথিকে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তখন একজন বলল, “ও তো অচিরেই পাগল হয়ে যাবে।” “না রে ভাই, বিয়ের পরে পাগল হবে — আফটার ইফেক্ট, বুঝলি!” এক রসিক লোক বলল, যে কিনা দুজনকেই চিনত।

ডরোথি ছোটবেলা থেকেই মানুষের কথার মাঝখানে বাম হাত ঢুকিয়ে দিত আর অন্যের বাকি কথাটা নিজেই বলে দিত। কখনো সে কথাটা শেষ করত ভুলভাবে , তাতে যারা কথা বলছিলেন তারা রাগ করতেন। আবার কখনো ঠিকভাবেই শেষ করত, তাতে তারা আরও বেশি রাগ করতেন।

“উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট যখন—” ডরোথির বাসায় একদিন  এক অতিথি এই এতটুকু বলার সঙ্গে সঙ্গেই ডরোথি লাফিয়ে উঠে বলেছিল, “প্রেসিডেন্ট!” লোকটি হয়তো ঠিক প্রেসিডেন্টই বলতে চাচ্ছিলেন, আবার এমনও হতে পারে তিনি বলতে যাচ্ছিলেন, “উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট যখন তরুণ ছিলেন,” কিংবা “উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।” তিনি আসলে কী বলতে যাচ্ছিলেন সেটা আর জানা গেল না! টুপিটা মাথায় সেটে খানিক পরেই বিদায় নিয়েছিলেন লোকটা। ডরোথির বাবা-মা, বেশিরভাগ বাবা-মার মতোই, বুঝতেই পারতেন না যে তাদের মেয়ের এই স্বভাবটা আসলে বিরক্তিকর।

বরং সম্ভবত তারা এটাকে বড্ড মিষ্টি, না হয় খুব বুদ্ধিদীপ্ত বলে মনে করতেন। এমনও হতে পারে, যেদিন প্রথম ডরোথির মা বলেছিলেন, “এসো ডরোথি, আজকে তোমার খাবার—”

আর ডরোথি তখন বলে উঠেছিল, “পালং শাক, তাই তো মা?”

সেদিনই তিনি অফিসে ফোন করে ডরোথির বাবাকে ঘটনাটা জানিয়েছিলেন। আর তিনি তখন সারা দিন—এমনকি পরের দিনও, আর তারও পরের দিন—যাকেই পেয়েছেন তাকেই সেই গল্প শুনিয়েছেন।

ডরোথি বড় হয়ে যথেষ্ট সুন্দরী হয়ে উঠল। আর তাতে বিপদের মাত্রাও গেল বেড়ে। তাকে দেখে বহু ভদ্রলোক প্রথমে আকৃষ্ট হতেন, পরে ধীরে ধীরে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তেন। ডরোথি তাদের আবেগে কাঁপন ধরাতো ঠিকই, কিন্তু খুব দ্রুতই তাদের মানসিকভাবে ক্লান্ত করে তুলত। এমনকি কৈশোরকালেই সে ছেলেদের ইংরেজি ব্যাকরণে ভুল ধরত। সে বলত, “‘ওয়াজ’ না আর্থার, ‘ওয়্যার’। ওয়্যার প্রিপেয়ার্ড—বুঝলে তো?”

তার সৌন্দর্যে মোহিত অনেকেই শুরুতে এই অভ্যাস মেনে নিত, কিন্তু সময় গড়াতেই বুঝতে পারত—তার উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দুতে না ছিল যৌবনের প্রেম, না সহানুভূতির আলিঙ্গন, কেবল ছিল ‘সংশোধন করার’ বাতিক। অবশেষে তারা ধীরে ধীরে তার থেকে দূরে সরে যেত। আর এর বদলে তারা কম খুঁতখুঁতে, একটু বোকাসোকা মেয়েদের দিকে নজর দেওয়া শুরু করত।

তবে, চার্লি ডেসলার ছিল খুব আবেগী আর বেপরোয়া গোছের। সে খুব তাড়াতাড়ি ডরোথির প্রেমে পড়ল, এবং দ্রুতই বাগদান সেরে ফেলে বিয়ে করল। সে তার বন্ধুদের সাবধানবাণী একেবারেই কানে তুলল না। তাদের উদ্বেগকে সে নিছক হিংসা বলে উড়িয়ে দিল। সে কিন্তু ডরোথির বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানতই না। শুধু এটুকুই জানত যে সে সুন্দরী, চোখ দুটো ঝকঝকে, আর খুবই আকর্ষণীয় (চার্লির দৃষ্টিতে)।

ডরোথি স্ত্রী হিসেবে যেন নিজ জীবনের পূর্ণ বিকশিত রূপে পৌঁছাল: অর্থাৎ সে এখন চার্লির গল্পগুলোতে ভুল ধরতে শুরু করল। চার্লি দেশে-বিদেশে ঘুরেছে বিস্তর, অভিজ্ঞতাও তার কম নয়, আর গল্প বলার গুণটাও ছিল একেবারে অনবদ্য। প্রেমপর্বে ডরোথি তার সব গল্প সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে শুনত। আর যেহেতু সে চার্লির বলা কোনো ঘটনার সাক্ষী ছিল না, তাই কখন, কোথায়, কার সঙ্গে, বা কবে কী ঘটেছে—সে নিয়ে চার্লি যদি একটু এদিক-ওদিক বলেও ফেলত, সেটা ডরোথির পক্ষে ধরার উপায় ছিল না। মাঝে মধ্যে কোনো ক্রিয়ার একবচন- বহুবচন নিয়ে ছোটখাটো খোঁচা দিত বটে, কিন্তু চার্লিকে মোটামুটি তার নিজের মতো গল্প বলার স্বাধীনতা সে দিয়েই রেখেছিল। তার ওপর, চার্লির ইংরেজিটাও ছিল বেশ ঠিকঠাক। “ইফ”–এর পর কোথায় “ওয়াজ” আর কোথায় “ওয়্যার” বসবে, সে ভালোভাবেই জানত। আর এই কারণেই ডরোথির সেই ছোটবেলার ‘ভুল-ধরার’ স্বভাব যে একদিন তার পুরো জীবনটাকেই গ্রাস করে বসবে, সেটা সে টের পায়নি।

ওদের বিয়ের পর অনেকদিন আমি আর খোঁজ রাখিনি কারণ, আমি চার্লিকে খুব পছন্দ করতাম। আর জানতাম, যদি আমি দেখি সে ডরোথির মোহজাল থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে এবং বাস্তবতার প্রথম হুলগুলো গায়ে ফোটার জ্বালা অনুভব করতে শুরু করেছে, তাহলে আমার মনটাই খারাপ হয়ে যাবে। তবুও শেষমেশ একদিন তাদের বাড়ি গেলাম। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতি ঠিক যেমনটা ভয় করেছিলাম, তেমনই ছিল।

ডিনারে বসে চার্লি গল্প শুরু করল—একটা মোটর ভ্রমণের কথা, যেটা তারা দুজনে একসঙ্গে করেছিল, এ শহর থেকে ও শহরে। কিন্তু কোন কোন শহরে যে তারা গিয়েছিল, সেটা আমার আজও জানা হয়নি। কারন, চার্লি যা-ই বলছিল, ডরোথি প্রায় সবই অস্বীকার করে যাচ্ছিল।

চার্লি বলল, “পরদিন আমরা বেশ সকাল সকাল রওনা দিলাম, আর দু-শো মাইল চালিয়ে ফেয়ারভিউ পৌঁছালাম —”

ডরোথি মাঝখানে বলে উঠল, “খুব যে ‘সকাল সকাল’ বেরিয়েছিলাম তা কিন্তু বলা যায় না। কারন, প্রথম দিনের মতন অতো সকালে আমারা বের হইনি, প্রথম দিন তো সাতটা নাগাদ উঠে পড়েছিলাম।  আর ওই দিন আমরা গিয়েছিলাম মোটে একশো আশি মাইল। আমার স্পষ্ট মনে আছে কারণ রওনা দেওয়ার সময় গাড়ির মিটারটা খেয়াল করেছিলাম। ‘দু-শো কেন বললে’?”

“যাই হোক, আমরা যখন ফেয়ারভিউ পৌঁছালাম—” চার্লি আবার বলতে শুরু করল। কিন্তু ডরোথি আবার তাকে থামিয়ে দিল। “সেদিন  কি আমরা সত্যিই ফেয়ারভিউ-এ গিয়েছিলাম, ডার্লিং?” ও জিজ্ঞেস করল। ডরোথি এভাবে প্রায়ই চার্লির কথা থামিয়ে দিত। কিন্তু ওকে বলত না যে ও ভুল বলছে; বরং ও জিজ্ঞেস করত, “তুমি ঠিক বলছ তো?” কিন্তু ফলাফল আসলে একই দাঁড়াত। কারন চার্লি উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত ওটা ফেয়ারভিউ-ই ছিল।” তখন ডরোথি বলল, “কিন্তু আমার মনে হয় ওটা ফেয়ারভিউ ছিল না, ডার্লিং,” তারপর ও নিজেই গল্পটা চালিয়ে গেল। (যে কারো সঙ্গে ডরোথির মতের অমিল হলে সে তাকে ‘ডার্লিং’ বলেই সম্বোধন করত।)

এক–দু’বার যখন আমি ওদের বাড়ি গেছি বা ওরা আমার বাড়ি এসেছে, তখন আমি খেয়াল করেছি ডরোথি চার্লিকে কোনো চমকপ্রদ ঘটনার গল্প প্রায় শেষ পর্যন্ত বলতে দিত। কিন্ত যখনই চার্লি গল্পের ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছাত, ঠিক তখনই ডরোথি হঠাৎ করে তাকে থামিয়ে দিত, ঠিক যেভাবে কেউ পিছন থেকে এসে গোললাইনের ঠিক আগমুহূর্তে থাকা খেলোয়াড়কে ফেলে দেয়। জীবনে এর চেয়ে বেশি মাথার যন্ত্রনা বা মনোবেদনা আর কোন কিছুতে হতে পারে! কিছু স্বামী আছে, যারা স্ত্রী মাঝপথে কথা থামিয়ে দিলে নড়ে-চড়ে না; বরং মুখে গর্বভরা  হাসি ঝুলিয়ে স্ত্রীর হাতেই গল্পের লাগাম ছেড়ে দেয়। কিন্তু সত্যি বলতে, এরাই হলো পরাজিত স্বামী। চার্লি মোটেই তেমন হেরে যাওয়া স্বামী না। ওদের বিয়ের দ্বিতীয় বছরের শেষে, যখন আমি ডেসলারদের বাড়ি গেলাম, তখন চার্লি এমন সব অদ্ভুত স্বপ্নের গল্প শুরু করত, যেগুলোতে ডরোথি ওকে শুধরাতে পারত না। কারণ ওর নিজের স্বপ্ন নিয়ে তো আর ওকে অন্য কেউ সংশোধন করতে পারে না। এই স্বপ্নগুলোই তখন চার্লির জীবনের একমাত্র অংশ হয়ে উঠেছিল যা একান্তভাবে ওর নিজের ছিল।

চার্লি তার স্বপ্ন নিয়ে বলতে লাগল, “আমি তো ভাবছিলাম, আমি একটা উড়োজাহাজ চালাচ্ছি। টেলিফোনের তার আর পুরনো চামড়ার টুকরো দিয়ে বানানো একটা উড়োজাহাজ। আমি সেটা নিয়ে সামনের ঐ চাঁদের দিকেই যাচ্ছিলাম। আমার ঘর থেকেই উড়ানো শুরু করেছিলাম। চাঁদের পথে অর্ধেকটা যাওয়ার পর, হঠাৎ দেখি একটা লোক হাত দেখিয়ে আমাকে থামতে বলছে। লোকটা দেখতে সান্তা ক্লজের মতো, তবে তার পরনে ছিল কাস্টমস অফিসারের ইউনিফর্ম। সে-ও একটা উড়োজাহাজে ছিল, সেটাও টেলিফোনের তার দিয়ে বানানো। আমি তখন একটুকরো মেঘের ওপর থামি। লোকটা বলল, ‘এই যে শুনুন, আপনি কি সেই লোক যে এই বিয়ের বিস্কুটগুলো বানিয়েছে? তাই যদি হয় তাহলে কিন্তু আপনাকে চাঁদে যেতে দেওয়া যাবে না।’ এরপর সে আমাকে একটা বিস্কুট দেখালো যেটার ওপরে ছিল ময়দা দিয়ে বানানো একটি বর-কনের মূর্তি। মূর্তিটা শক্তপোক্তভাবে গোল, মচমচে একটা বিস্কুটের উপরে বসানো ছিল।” তারপর তার গল্প এভাবে চলতেই থাকত।

যে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞই বলবেন—চার্লি যে পথে হাঁটছিল, তার শেষ স্টেশন হলো একধরনের একগুঁয়ে পাগলামি—মোনোম্যানিয়া। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত—একটা অবাস্তব স্বপ্নের মধ্যে বাস করে কেউ সুস্থ থাকতে পারে না। ধীরে ধীরে চার্লির জীবনের আসল সুর ও রঙ ম্লান হয়ে গেল, আর সে যেন শুধু ছায়ার ভেতর বসবাস শুরু করল। এই ধরনের একমুখী উন্মাদনার ফলে সে একটা গল্পই বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে থাকত। চার্লির কল্পনার ঝুলি ফাঁকা হয়ে আসছিল, আর শেষে গিয়ে সে শুধু সেই প্রথম স্বপ্নটা শুনিয়ে যেত— টেলিফোনের তার আর পুরনো চামড়ার টুকরো জোড়া দিয়ে বানানো উড়োজাহাজে চেপে তার অদ্ভুত চাঁদের পথে উড়াল। শুনতে আমাদের ভীষণ কষ্ট হতো। সবাই প্রচন্ড মনখারাপ করতাম। কারণ, ওই হাস্যকর কল্পনার আড়ালে আমরা ধীরে ধীরে তার ভেঙে পড়া দেখতে পাচ্ছিলাম।

কয়েক মাসের মধ্যেই অবশেষে চার্লিকে পাঠাতে হলো পাগলাগারদে। ওকে নিয়ে যাওয়ার দিন আমি শহরের বাইরে ছিলাম, কিন্তু জো ফল্টজ ওর সঙ্গে গিয়েছিল, আর সেই আমাকে চিঠিতে সব জানিয়েছিল। “এখানে এসে চার্লি মনে হয় প্রথম দিনই বেশ খুশি হয়ে গেল,” লিখেছিল জো। “অনেক শান্ত হয়ে গেছে, চোখদুটোও দেখতে ভালো লাগছে।” (চার্লির চোখে আগে এক ধরনের আতঙ্কিত, শিকারির তাড়া খাওয়া মানুষের চাহনি দেখা যেত।) চিঠির শেষে জো লিখেছিল, “অবশেষে চার্লি ওই ডাইনির হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে।”

দুই সপ্তাহ পর চার্লিকে দেখতে আমি গাড়ি চালিয়ে গেলাম পাগলাগারদে। সে শুয়ে আছে একটা ছোট্ট খাটে, বড়সড় জাল-ঘেরা বারান্দায়। আর মুখে ক্লান্তি, আর শরীর শুকিয়ে একেবারে হাড়-জিরজিরে হয়ে গেছে। চার্লির বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে ডরোথি—চোখদুটো উজ্জ্বল, মুখে চিরচেনা উচ্ছ্বাস। ওকে সেখানে দেখে আমি খানিকটা অবাকই হলাম; ভেবেছিলাম অন্তত এখানে এসে চার্লি তার স্ত্রীর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু না, চার্লির চেহারায় পাগলামির ছাপ স্পষ্ট। আমাকে দেখেই সে শুরু করল চাঁদে যাওয়ার সেই কল্প-গল্প। চার্লি গল্পের সেই অংশে এসে পৌঁছোল যেখানে সান্তা ক্লজের মতো দেখতে এক ব্যক্তি তাকে থামতে ইশারা করেছিল। “সে-ও একটা টেলিফোনের তার দিয়ে বানানো বিমানে ছিল,” বলল চার্লি। “তাই আমি গিয়ে ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে পড়লাম—”

“না, তুমি ফুটপাতে না, একটা মেঘের ধারে দাঁড়িয়েছিলে,” ডরোথি ঠিক করে দিল। “আকাশে কোনো ফুটপাত হয় না—হতেই পারে না। তুমি দাঁড়িয়েছিলে মেঘের ধারে।”

চার্লি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, খাটে খানিকটা গড়াল, আর আমার দিকে তাকাল। ডরোথিও তাকাল আমার দিকে, ঠোঁটে সেই চিরপরিচিত সুন্দর হাসি ঝুলিয়ে বলল, “ও সব সময়ই এই গল্পটা ভুল বলে।” 

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *