ফেরি-তে// মূল গল্প: এন.ভি.এম. গঞ্জালেজ// অনুবাদ: তাসনিয়া ইসলাম

ম্যানিলা থেকে বাটাঙ্গাস পর্যন্ত আড়াই ঘন্টার পুরো যাত্রায় তারা যথেষ্ট ভোগান্তিতে পড়েছিল। ফেরিটার একদম পেছনের দিকের সিটগুলো ছাড়া আর কোনো সিটই ফাঁকা পাওয়া গেলো না। লোকে অবশ্য ফেরির এই অংশটাকে ‘হলিউড’ বলে ডাকে। জানা যায় যে এটাকে আগে রান্নাঘর হিসেবে ব্যাবহার করা হতো। বলাই বাহুল্য যে, এইখানে এসে বসাটা খুব একটা আরামদায়ক ছিল না। তবে কখনো কখনো কিছু ব্যাপার একেবারেই এড়ানো যায় না: বিশেষ করে যদি আপনি ফেরিঘাটে দেরি করে পৌঁছান; কিংবা, আপনার ছেলেকে কলেজে পড়াবার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থের যোগান দিতে না পারেন; তখন এই হলিউডের মতো আরও অনেক কিছুকেই নীরবে মেনে নিতে হয়। 

মিস্টার লোপেজ অবশ্য এর আগেও এমন পরিস্থিতিতে বহুবার পড়েছেন; তাই আজকে ফেরির এই খারাপ সিটগুলো নিয়ে তার তেমন কোনো মাথাব্যাথা হচ্ছে না। এগুলোকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে, বরঞ্চ এই ব্যাপারটাকে একেবারেই মাথা থেকে বের করে দিয়ে নীলোর দিকে মন দিলেন তিনি।

“তুমি কি আমাদের লাগেজগুলো চেক করেছিলে?”

তার পাশে কাঠের বেঞ্চে বসে থাকা চশমা পরা রোগা মতন ছেলেটা উত্তর দিল: “হ্যাঁ, বাবা।”

“আরও একবার চেক করে দেখ তো!” 

ছেলেটা উঠে গিয়ে সিটের নিচে উঁকি দিয়ে আসলো। কুলিটা সেখাননে একটা পুরানো স্যুটকেস, কিছু বই ও ম্যাগাজিন ভর্তি দু’টা বড় বাক্স, আর মুদির দোকানের দু’টা কাগজের ব্যাগ ঢুকিয়ে রেখেছিল।

ফেরি ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে প্রায়। বেশ অনেকক্ষনই হয়ে গেল তাদের ফেরিতে ওঠার– “বাবা, চলো আমরা ভিড়টাকে এড়াতে একটু তাড়াতাড়ি পা চালাই”– বলেছিল নীলো। আর তখন তাদেরই মত আরও অসংখ্য মানুষের একটা অবিচলিত স্রোত যাত্রীবাহী এই ফেরিটার দিকে এগিয়ে আসছিল। তাদেরকে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন ম্যানিলা শহরের ধুলোমাখা বুক ফুঁড়ে উঠে আসছে অতিকায় সব লাল পোকাদের দল। 

লোপেজ সাহেব তার ছেলেকে নিয়ে ডানদিকের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলেন; তিনি হয়ত আশা করেছিলেন, অন্তত এই বেঞ্চটার পুরোটাই তিনি নিজের আয়ত্তে নিতে পারবেন। কিন্তু তিনজন মধ্যবয়সী মহিলা আর দুইজন তরুণীর একটা দল সেই আশায় গুড়ে বালি দিয়ে বেঞ্চের অপর প্রান্তটা দখল করে বসলো। আর তাদেরকে অনুসরণ করে সেখানে উপস্থিত হলো কমলা রঙের ফতুয়া পরা একদল কুলি, যাদের মাথা ও কাঁধ বোঝাই ছিল– ফলের ঝুড়ি, স্যুটকেস আর মুদির দোকানের কাগজের ব্যাগ দিয়ে। সেগুলো তারা বেঞ্চের নিচের ফাঁকা জায়গাটুকুতে কোনমতে ঠেসে ঢুকিয়ে দিল। একজন মহিলা নীলোর পাশে এসে বসলেন। বাকি দুইজন বসলেন বেঞ্চের শেষ প্রান্তে। তাদের সাথে যেই দুই তরুনী ছিল তাদেরকে বসতে দেওয়া হলো প্রান্তে বসা দুই বয়স্কার মাঝে। তরুণী দুইজন বেশ সাদামাটা চেহারার। তাদের পরনে সেন্ট ব্রিজেট কলেজের ইউনিফর্ম। সম্ভবত এই দুই তরুণী সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে আত্মীয়দের সঙ্গে ক্যালাপান যাচ্ছিল।

একসময়কার সহকারী জেলা প্রকৌশলী মিস্টার লোপেজ কোনভাবেই চাইছিলেন না যে, ক্যালাপানের কোন পরিচিতের সাথে তার হঠাৎ দেখা হয়ে যাক। এই মহিলাদের কেউই তার পরিচিত নয় দেখে মনে মনে স্বস্তি পেলেন তিনি। আসলে তার মনে ভয় ছিল যে সরকারী চাকুরির কোন প্রাক্তন সহকর্মী, কিংবা তার কোন ব্যবসায়িক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়াটা তার জন্য মারাত্মক বিব্রতকর হয়ে উঠতে পারে। 

‘লোপেজ এন্ড কোং বিল্ডার্স’ নামের তাদের নিজস্ব নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটা একসময় অনেকগুলো সরকারি প্রকল্পের কাজ করেছিল। মোটামুটি পুরো মিণ্ডারো জুড়েই তারা সেতু আর নদী নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প নির্মাণ করে দিয়েছিল। যদিও লোপেজ সাহেবের ধারণা, মানুষ হয়ত এখন শুধু বাদজাও বাঁধের কথাটাই মনে রেখেছে। বিদেশী মালিকানাধীন সেই কাঠের কোম্পানিটা মাউন্ট হ্যালকন পাহাড়ের চারপাশের ঘন বনটার গাছগুলি অমন নির্বিচারে কেটে পুরো এলাকাটাকে বিশ্রিরকম নগ্ন করে ফেলবার আগে কারও পক্ষেই চট করে এটা ঠাহর করার উপায় ছিল না যে বাঁধটা ঠিক কোনদিক থেকে এসেছিল। কিন্তু সত্যটা হলো, ১৯৫৬ সালের বন্যায় বাঁধটা ভেসে গিয়েছিল, আর সেই সাথে তাদের কোম্পানিটাও। এরপর থেকে তারা নতুন করে আর তেমন কোন চুক্তি পায়নি।

কুলিদের ডেকের উপরে-নীচে ছোটাছুটি করা বন্ধ হয়ে আসলো। ফেরিটা বেশ জোরালোভাবে একবার কেঁপে উঠল। এই কম্পনের তীব্রতা আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিল জেটি থেকে আসা প্রচণ্ড শোরগোল, যেখানে রঙিন  বাসগুলি আশা ছেড়ে স্থির হয়ে এক রকম ঘড় ঘড় আওয়াজ করছিল। অবশেষে ভেঁপু বাজল; খোলা সমুদ্রের দিকে রওনা হলো ফেরিটা।

একটা পরিষ্কার ঝকঝকে সকাল। জুলাই মাসের প্রথম দিকের দিন হিসেবে এই ব্যাপারটা একরকম অস্বাভাবিক। যদিও লোপেজ সাহেব এই ভ্রমণটা আগেও বহুবার করেছেন কিন্তু তারপরও কেন জানি প্রতিবারই এটা তাকে মুগ্ধ করে। মধ্য সকালের রোদে প্রাদেশিক এই রাজধানী বাটাঙ্গাস তার পুরানো গির্জার গম্বুজগুলো সমেত ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। আর রোদের আলোতে জ্বলজ্বল করতে থাকা গম্বুজগুলোকে অবিকল সদ্য উন্মোচিত সবুজ সোয়েডের বাক্সে রাখা মহামূল্য রত্নের মতো দেখাচ্ছে।

ফেরিটা মিণ্ডারো উপকূলের দিকে মোড় নিতেই লোপেজ সাহেবের চোখের সামনের মনোরম সেই দৃশ্য ঢাকা পড়ে গেলো ধূসর ক্যানভাসের শামিয়ানাতে। বাতাসের তোড়ে সেই শামিয়ানা এলোমেলো ডানা ঝাপ্টাচ্ছিল। হঠাৎ নিজেকে ডেকের বামদিকের রেলিং ধরে ঝুঁকে থাকতে দেখে একটু চমকে গেলেন তিনি। 

এইতো মাত্র আঠারো বছর আগে একজন তরুণ প্রকৌশলী হয়ে সেন্ট ব্রিজেট কলেজের এক ছাত্রীকে বিয়ে করে এমনই একটা ফেরিতে মিণ্ডারো পার হচ্ছিলেন তিনি। তবে ঐদিন তারা দুজন একসাথে রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলেন কিনা, কিংবা বাটাঙ্গাসের দিগন্তকে চোখের সামনে মেলে রেখে তারা ভাবী দিনগুলোকে ঘিরে দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন কিনা, সে-সব ঠিক মনে করতে পারলেন না।

নীলো বেঞ্চেই বসে ছিল, আর কোথাও থেকে একটা ম্যাগাজিন বের করে পড়তে শুরু করেছিল। ডেকের উপর বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা ব্যাগপত্রের মধ্য দিয়ে পথ তৈরি করতে করতে  সিটে ফেরার সময় লোপেজ সাহেব ভাবছিলেন যে ম্যাগাজিনটা হয়ত ‘দি বুকওয়ার্ম’ হবে। ছেলেটা নির্ঘাৎ তার মায়ের কপাল আর চিবুক পেয়েছে; আর শরীর স্বাস্থ্যের দিক থেকেও সে বেশ পলকা গোছেরই। বয়স ষোল হলেও চোখে চশমা থাকার কারণে তার বয়স অন্তত দুই থেকে তিন বছর বেশী মনে হয়। কিন্তু আদতে আচরণের দিক থেকে সে এখনও অনেকটাই বালকসুলভ। তবে নীলো মোটামুটি এক বছরের জন্য কলেজ কার্যক্রমের বাইরে থাকবে। যদিও মিস্টার লোপেজের বিশ্বাস যে পরের বছর নিশ্চয়ই নীলোর ভাগ্যের উন্নতি হবে, আর সে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হতে পারবে। হঠাৎ করেই গত বছরে লেখা নীলোর একটি চিঠির কথা মনে পড়ে গেলো তার। তাতে লেখা ছিল কিভাবে সে কাবারের অভাবের সাথে লড়াই করে যাচ্ছিল। কোনকোনদিন সকালের নাশতায় এক বোতল কোকাকোলাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো তাকে। চিঠির কথাগুলো তাকে আবার খুব নাড়া দিল যেন; দুর্বল বোধ করতে শুরু করলো সে। লোপেজ এন্ড কোং বিল্ডার্সের ভয়াবহ ব্যর্থতার ভার এই ছেলেটাকে এখনও বহন করে বেড়াতে হচ্ছে। এই বছর তো সে কলেজে পর্যন্ত পড়তে পারবে না। নীলো এক দেউলিয়া বাবার সন্তান, আর সেটা ভাবতেই ছেলের জন্য খুব মায়া হতে লাগলো তার।

কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে নীলোর হাতে ধরা ম্যাগাজিনটার দিকে ইশারা করে তিনি বললেন, “খুব ইন্টারেস্টিং নিশ্চয়ই!” লোপেজ সাহেবের কণ্ঠে সচেষ্ট প্রফুল্লতা। “ওটা কি রিডার্স ডাইজেস্ট?” 

“এটা ওদের”– সেন্ট  ব্রিজেটের মেয়ে দুইজনের দিকে ইশারা করে দেখালো নীলো। পৃষ্ঠা উল্টালো সে। মিস্টার লোপেজ চট করে প্রবন্ধের শিরোনামটা পড়ে ফেললেন– ‘আমার প্রিয় অবিস্মরণীয় চরিত্র।’

“এটা কার সম্পর্কে লেখা?” 

“গো-ই-থালস”, বলল নীলো। তিনি এই পানামা খাল খনন করেছিলেন।

মেয়ে দুইজনের দিকে তাকালো নীলো: “তোমরা তো ওনার নামটা এইভাবেই উচ্চারণ করো, তাই না?” অপর পাশ থেকে সংশোধনী আসলো, “উঁহু, গো-থালস”!

মেয়ে দু’টো আশ্চর্যরকম স্বতঃস্ফূর্ত! পরিচয়পর্বটাকে এড়িয়ে যাবার আর কোন উপায় রইলো না তাই। ঠাট্টার ছলে তিনি কটাক্ষ করলেন নীলোকে, “কী! বান্ধবীদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেবে না নাকি?”

জানা গেলো তরুনী দুইজনের নাম মেরী এবং রোজ। আর সাথের তিন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা সম্পর্কে তাদের খালা। মজার ব্যাপার হলো, এনারা তিনজনই আবার কুমারী। লোকে এনাদের আদিভা সিস্টার্স বলে চেনে। আর এনারা তিনজনই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। 

তিনজন আদিভার একজন বলে উঠলেন– “আজকাল তো সবাই বলাবলি করছে, বিজ্ঞান ভালো করে না জানলে কিচ্ছু হবে না”!

“কিন্তু আমাদের জাতীয় ভাষায় তো বিজ্ঞানের কোন শব্দভাণ্ডারই নেই”– দ্বিতীয় আদিভা প্রতিবাদ করলেন। 

তিনি স্পষ্টতই একজন তাগালগ ঘরানার শিক্ষিকা (ইংরেজি ভাষায় ক্লাস পরিচালনার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যিনি নীতিগতভাবে ফিলিপাইনের স্থানীয় ভাষাতেই ক্লাস নেওয়ার পক্ষপাতী), ভাবলেন মিস্টার লোপেজ।  

“এখন সবাইকে গণিতে ভালো হতেই হবে, সেও তো সত্য। তাই না?”– তৃতীয় জন জিজ্ঞেস করলেন, দৃশ্যত এই তিনজনের মধ্যে তিনিই সব থেকে নিরীহ ও ভদ্র প্রকৃতির।

“আসলে আমি এই বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব ভালো করে জানি না,” মিস্টার লোপেজ বললেন বিড়বিড় করে। “আমি তো শুধু একজন সাদামাটা ব্যবসায়ী।”

“আপনি একটু বেশীই বিনয়ী হচ্ছেন না তো ইঞ্জিনিয়ার সাহেব?”– প্রথমজন একটুখানি ফোড়ন কেটেই বললেন যেন!

এই তিন মহিলা সত্যিই বেশ আশ্চর্য রকমের।

তাদের চেহারাসুরত ও বেশভূষায় মিস্টার লোপেজ কোনভাবেই অনুমান করতে পারেননি যে তারাও পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করছে। আর তারাও তাদের যার যার অবস্থান থেকে অগ্রগতির প্রচলিত ও জনপ্রিয় কিছু ধারণার কারণে জটিলতায় পড়ে গেছে। ব্যাপারটা বেশ উৎসাহদায়ক ছিল বটে!

“নীলো! দেখো, ফেরির ওইপাশটাতে একটা ক্যান্টিন আছে। তুমি তো এক দৌড়ে গিয়ে সবার জন্য কিছু কোক আনতে পারো।” ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন লোপেজ সাহেব। কিন্তু দ্বিতীয় আদিভা নীলোর জামার হাতায় আলতো করে একটা টান দিয়ে, মাতৃস্নেহ-মাখা কণ্ঠস্বরে তাকে সিট ছেড়ে না উঠার জন্য অনুরোধ করলেন।

নীলো তবুও তার হাতের পত্রিকাটা রোজ নামক মেয়েটাকে ফেরত দিয়ে সিট থেকে উঠে দাঁড়াল। চোখের চশমাটা নাকের উপর একটু ঠেলে তুলে দিয়ে সে তার পকেটে রাখা কয়েনগুলো বের করল এবং কোনরকম অস্বস্তি বা ইতস্ততভাব ছাড়াই সেগুলো গুনতে শুরু করল। আর এমন একখানা দৃশ্য সেন্ট ব্রিজেটের মেয়ে দু’টোর জন্য বেশ মজারই বটে।

“কি তোমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে তো, নাকি?” – মিস্টার লোপেজ জানতে চাইলেন। নীলোকে তার নিজের পকেট থেকে একটি পেসো দিতে উদ্যতও হলেন তিনি।

“লাগবে না, বাবা” – বলল, নীলো।

নীলো চলে যাওয়ার পর মিস্টার লোপেজ বললেন, “ও সত্যিই চমৎকার একটা ছেলে। তবে আজকাল আবার ছেলেপেলেদের খুব বেশি পরিমাণ পকেট-মানি দিতে নেই, এতে ওরা বখে যেতে পারে”।

“আমাদের মধ্যে বেশ সচেতন একজন বাবা আছে দেখছি” – বললেন প্রথম আদিভা।

মিস্টার লোপেজ যেন ঠিক এমন একটা মুহূর্তেরই অপেক্ষা করছিলেন। নীলো সম্বন্ধে এনাদের আরও যা জানা উচিত তা হলো, নীলো ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। তাও আবার ইউ. পি. (ইউনিভার্সিটি অফ ফিলিপিন্স)-এর। আর এই প্রতিষ্ঠানের মান যে সর্বচ্চ সেটা যোগ করবার লোভও সামলাতে পারলেন না তিনি। পরবর্তি কথোপকথনগুলো থেকে মিস্টার লোপেজ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে এই মহিলারা ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে অতি উৎসাহী, আর তারা আরও মনে করেন, ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাটা যথার্থ কারণেই দিনকে দিন জনপ্রিয়তার শিখরে উঠে আসছে। যাইহোক, এসব কথার প্রতিউত্তরে মিস্টার লোপেজ হ্যাঁ-সূচক দুই একটি মন্তব্য করলেন মাত্র।

“নীলোর জন্য এটাই সেরা পছন্দ,” দ্বিতীয়জন আওড়ালেন আবারও।

“তবে জানেন তো, এর আগে কিন্তু আইনই সেরা ছিল।” তৃতীয়জন আবার বেশ প্রত্যয়ের সাথেই বলে উঠলেন উত্তরে।

“মাফ করবেন। তবে আমি কিন্তু মনে করি, আপনাদের স্কুল শিক্ষকদের অনেকেই হয়ত এই ব্যাপারটা এখনও উপলব্ধি করতে পারেননি যে বর্তমান সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে আপনাদেরকেও একটা নতুন ধরণের ছাত্রগোষ্ঠী তৈরি করতে হবে”– বললেন, লোপেজ সাহেব।

“ধন্যবাদ! একদম ঠিক বলেছেন আপনি!” সমর্থন পেয়ে দ্বিতীয় আদিভা বেশ আহ্লাদিত। এতে তৃতীয়জন বেশ জোরেশোরে বলে উঠলেন, “তবে একটা ব্যাপারে পরিবর্তন নিশ্চয়ই এসেছে– শিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে”।   

“তা-কি আর আমি জানি না?” মিস্টার লোপেজ বললেন। বিষয়টাই এমন যা সম্পর্কে তার প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত জ্ঞান ছিল। “আমার পরিবারেও তো একজন কলেজ-পড়ুয়া আছে”।

“আপনার সন্তান কি এই একজনই?”– প্রশ্ন করলেন দ্বিতীয় আদিভা। “অবশ্য আপনার অস্বস্তি হলে বলার প্রয়োজন নেই।”

“না, না, এতে লুকানোর কি আছে! আমার তিনটা ছেলে এবং একটা ছোট মেয়ে আছে”, বললেন মিস্টার লোপেজ। 

“ব্যস! এখানেই শেষ?”– তৃতীয় আদিভার চোখে খানিকটা সন্দেহ। লোপেজ সাহেব তার কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন। পাছে অন্য দুইজন বাদ পড়ে গেছে এমনটা যেন মনে না হয়, তাই তিনি বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলেই ফেললেন, মিসেস লোপেজ আবারও সন্তানসম্ভবা। হঠাৎ করে নিজের আচরণে নিজেই বেশ অবাক হয়ে গেলেন তিনি। মনে হতে থাকলো যে আরও কিছু মুহূর্ত কেবল, তারপরই তিনি এই মহিলাদের তার জীবনের পুরো গল্পটাই বলে ফেলবেন। দ্রুত নিজেকে সংযত করে নিলেন তিনি। খুবই সচেতনভাবে বাকি কথোপকথনটুকুকে নীলোর পড়ালেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলেন। 

বললেন, “নীলো কিন্তু আবার ওর মায়ের খুব প্রিয়।” তবে নীলোর স্বাস্থ্য যে বরাবরই খুব পলকা আর নাজুক গোছের তাও জানালেন লোপেজ সাহেব। ভর্তিপরীক্ষার সময়ে নীলোর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ডীনের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎকারের গল্পটা বললেন সবাইকে। কলেজের ডীন তাকে একটি সিগার অফার করেছিলেন, আর কাঁধে হাল্কা একটা চাপড় দিয়ে বলেছিলেন: “সবই তো ঠিক আছে লোপেজ সাহেব, কিন্তু স্বাস্থ্যই যে মূল সম্পদ”!

আলোচনা নতুন দিকে মোড় নিতেই আদিভা সিস্টার্সরা বেশ চাঙ্গা হয়ে নড়েচড়ে বসলেন। তারা পুরোপুরিভাবেই নিশ্চিত যে বর্তমানে ম্যানিলার জীবনযাপনের ব্যবস্থা তরুণ প্রজন্মের জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। ম্যানিলার ধুলোবালি, কোলাহল, গিজগিজে বোর্ডিং হাউস থেকে শুরু করে সস্তাদরের বস্তাপচা সিনেমা পর্যন্ত সবকিছু নিয়েই তাদের রাজ্যের অভিযোগ। তাদের মতে এই সব ব্যাপারগুলোও নিশ্চয়ই নীলোর খারাপ স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী। আর হয়তো মিস্টার লোপেজও একান্তভাবে এই কথাটাকেই বিশ্বাস করে মেনে নিলেন।

“কিন্তু আজকাল আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের আর কোথায়ই বা পাঠাতে পারি?” – স্নেহ ও সহানুভূতির প্রকাশ তার গলায়।

প্রশ্নটি এই তিন ভদ্রমহিলাকে একটু ব্যাথিত করে তুলল যেন। প্রথমজন তার ডাগর চোখে ঘনঘন কয়েকটা পলক ফেললেন। ”তবে যাই বলুন না কেন লোপেজ সাহেব, আপনার কিন্তু নীলোর উপরে খুব বেশি পড়াশোনার চাপ দেওয়া একদম উচিত না।”

“হ্যাঁ, ওর মাও সবসময় এই কথাই বলে”– জবাব দিলেন মিস্টার লোপেজ।

“হ্যাঁ, আপনার অবশ্যই আরও সাবধান হওয়া উচিত”– বললেন দ্বিতীয়জন। “আর জানেনই তো, এই বয়সের ছেলেদের কিন্তু খুব সহজেই প্লুরিসি হয়ে যায়। আমার একটা ভাতিজা ছিল, জানেন…”

এরপর তারা তাদের সেই দুর্ভাগা ভাতিজাকে নিয়ে আলাপ চালিয়ে গেল।

এর পরপরই নিলো সাত সাতটা স্ট্র গোঁজা কোকের বোতল দুইহাতে কোনমতে আঁকড়ে ধরে হাজির হলো। তার পায়ের নিচে ডেকটাকে আরও খানিকটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে হলো; আর বসার বেঞ্চটাকে হিঁচড়ে খানিকটা সামনে নিতে হল যাতে নিলো বোতলগুলোকে নিরাপদে সবার হাতে পৌঁছে দিতে পারে। সবাই যখন চুপচাপ তাদের কোকে চুমুক দিচ্ছে, মিস্টার লোপেজ বললেন, “নীলোর মা-ও সেন্ট ব্রিজেটের ছাত্রী ছিলেন।” এটি নিঃসন্দেহে একটি চমকপ্রদ তথ্য, বিশেষ করে মেরি এবং রোজ নামক দুই তরুণীর কাছে। “আচ্ছা, মিসেস লোপেজ কি আমাদের থেকে আলাদা ইউনিফর্ম পরতেন?”– অদম্য অপরিসীম কৌতুহল তাদের চোখেমুখে।

কিন্তু আদিভা সিস্টার্সরা আবারও ঘুরে ফিরে নীলোর স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে ফেরত আসলেন। তিনজনই দ্ব্যর্থহীনভাবে সমান উদ্বেগ প্রকাশ করলেন।

ক্যান্টিন থেকে কোকের বোতল হাতে  নাজুক নীলোর সিটে ফিরে আসার দৃশ্যটা তাদের মধ্যে এমন সব অনুভূতি জাগিয়েছিল যেগুলো হয়ত অনেকক্ষণ ধরে তাদের মনের ভেতর সুপ্ত অবস্থায় ছিল। আবারও এই কথা উঠে যে, পড়ালেখাকে ওর স্বাস্থ্যের থেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া একদমই উচিত হবে না। “হ্যাঁ, ঠিক তাই”– সমস্বরে বলেন তিনজনই। তাদের মতে ওকে কিছুদিনের জন্য বাড়ি পাঠিয়ে কলেজ ঠিক কাজটাই করেছে। প্রথমজন একটু অপ্রত্যাশিতভাবে সরাসরি নীলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন: “তোমার বাবা বললেন, তোমার বয়স নাকি মাত্র ষোল!” এটি কি একটি প্রশ্ন নাকি বিবৃতি, তা তার কণ্ঠস্বর আর বলার ধরন থেকে মোটেও বোঝার উপায় ছিল না। একটু হকচকিয়ে উঠে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো নীলো। মিস্টার লোপেজ তার ছেলের বয়সের ব্যাপারটা একটু স্পষ্ট করতে চাইলেন। “না, আসলে আগামী সেপ্টেম্বরে ওর ষোল পূর্ণ হবে”। নীলোর মুখটা লজ্জায় একটু লাল হয়ে উঠল; অবশ্য মেরি এবং রোজের লজ্জায় লাল হয়ে ওঠাই হয়ত তার কারণ। এরপর, বয়স প্রসঙ্গে আলাপ চলতেই থাকলো। আদিভাদের প্রথমজন রীতিমত বিশদ বিবরণ দিয়ে জানালেন, তাদের এই দুই ভাগ্নির বয়সও ষোল, আর ওরা দুইজন আসলে জমজ বোন। 

ফেরিটা এবার উত্তাল সাগরের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে। এর মানে হল, তারা ভার্দে আইল্যান্ড এর প্যাসেজের মাঝখানে পৌঁছে গিয়েছে। ফেরিটা ভার্দে দ্বীপের উপকূলের কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত আধা ঘণ্টারও বেশী সময় ধরে তিন ফুট উচ্চতার একেকটা ঢেউয়ের সাথে অনবরত লড়াই করতে থাকলো। আর তার ফলাফল হিসেবে তাদের বসার বেঞ্চটা একবার পিছলে খানিকটা সামনে যায়, আর একবার পিছনে রেলিংয়ের দিকে কাত হয়ে যায়। নৌযাত্রি হিসেবে আদিভারা দুর্দান্ত পটু; রীতিমতো বিস্ময়কর। তাদেরকে দেখে মনে হল তারা যেন এই প্যাসেজটা পাড়ি দিতে ভিষণ অভ্যস্ত। কিন্তু বেচারা নীলোর অবস্থা খুব সঙ্গিন হয়ে পড়ল। প্রথম আদিভা নিজে থেকেই সমুদ্রপীড়িত নীলোর দেখাশোনার ভার নিয়ে নিলেন এবং সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে সেই দায়িত্ব পালনও করতে শুরু করলেন। বসার বেঞ্চটাতে প্রয়োজনীয় জায়গা সংকুলান করে তিনি নীলোকে শুইয়ে দিলেন। 

“ঠিক হয়ে যাবে ও,” মিস্টার লোপেজ বললেন। “আপনি খামোখা এতো চিন্তা করবনে না প্লিজ।”

“পনেরো বছরের মধ্যে নাকি এইখান দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ হবে। তখন আমরা সবাই ট্রেনে চেপে নিচ দিয়ে যাবো।” যেন স্বপ্নঘোরের মধ্যে বলে উঠলেন দ্বিতীয় আদিভা। 

“আমাদের যে আরও অনেক ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন হবে এটাও তার একটা কারণ”- তৃতীয় আদিভা সুযোগ বুঝে কথাটা বলতে ছাড়লেন না।

নীলো বেঞ্চের উপর থেকে মাথাটা একটু তুলল। কেউ যে ভবিষ্যৎ নিয়ে এত আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে পারে তা দেখে বেশ অবাক সে।

সাগর আবার শান্ত এখন। মসৃণ পানি বৃষ্টির মতো শব্দ তুলে ফেরির দৈর্ঘ্য বরাবর বয়ে যেতে লাগল। টুনা মাছের একটা ঝাঁক অজান্তেই হঠাৎ গলুইয়ের সামনে পড়ে হতচকিত হয়ে পড়ছে। 

ক্যালাপান বন্দরকে তিন দিক থেকে ঘিরে রাখা তিনটা দ্বীপের একটির অবয়ব চোখের সামনে ভেসে উঠল আচমকাই। আর ঠিক তখনই জমজ দুই বোন চেঁচিয়ে উঠল, “দেখো একটা নৌকা”! 

মিস্টার লোপেজ দ্রুত সেদিকে মুখ ফেরাতেই একটা অন্তত পাঁচ-টন ওজনের এক মাস্তুল বিশিষ্ট পালতোলা নৌকা দেখতে পেলেন, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ল্যাঞ্চন। ছোট্ট দ্বীপটা যেখান থেকে শুরু হয়েছে, সেখানে শুভ্র চকচকে বালির পাতলা চাদরের প্রান্তে অনেকগুলো নারিকেল গাছের বেশ ঘন একটা সমারোহ। গাছগুলোতে ঝুপরে নারিকেল ধরে আছে। আর এমনই একটা মনোরম ও নিরাপদ আশ্রয়ে রক্ষিত নৌকাটা কেমন যেন অদ্ভুতরকম খাড়াভাবে কাৎ হয়ে আছে। ব্যাপারটা নিয়ে আদিভা পরিবারের সবাইকে বেশ উত্তেজিত মনে হলো। নৌকাটাকে ঘিরে তাদের জল্পনা-কল্পনার যেন শেষ নেই। আর নিজেদের অনুমানগুলো একে অপরকে বলার সময় তাদের শ্বাস ও কণ্ঠ দুই-ই মৃদু মৃদু কাঁপছে। 

একজন বলল, নৌকাটাতে নিশ্চয়ই কোন ছিদ্র আছে তাই পানি উঠে ওটা একদিকে কাৎ হয়ে গেছে। আর একজন বলল, না, হয়ত ওটা কোন একটা পাথরের ওপর রাখা আছে, তাই অমন। অন্যজন খেয়াল করল যে, নৌকাটাতে কোন নাইয়ে নেই।  

নৌকাটা কেমন রহস্যজনকভাবে পরিত্যক্ত। মিস্টার লোপেজ আনমনে কামনা করতে লাগলেন, যেন তাদের ফেরি ঐ নৌকাটার কাছাকাছি দিয়ে যায়। যদিও তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন, এতে কাররই তেমন কোন লাভ হবে না; কারণ, নৌকাটাতে জনমানুষের কোন চিহ্ন নেই।

রহস্যময় নৌকাটাকে ঘিরে আদিভা পরিবারের সদস্যদের সমস্ত জল্পনা-কল্পনা, ফিসফাস ও গুঞ্জন  শেষ হতেই নীলো গম্ভীরভাবে বলে উঠল– “আমার কিন্তু মনে হচ্ছে নৌকাটা ডুবে যাচ্ছে”। 

মেরি ও রোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালো যে ওদেরও একই কথাই মনে হচ্ছে। একে অপরের হাত খামচে ধরে রেখে তারা রুদ্ধশ্বাসে নৌকাটার দিকে তাকিয়ে রইল। 

“বাবা দেখো! ওটা ইঞ্চি ইঞ্চি করে ডুবে যাচ্ছে, তাই না?” নীলোর কণ্ঠে সমর্থন পাবার আশা, হয়ত একপ্রকার অনুনয়ও।  

আদিভা সিস্টার্সরা একসাথে নাটকীয় ভঙ্গীতে সজোরে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, তাই তো! ওই তো ওটা ডুবে যাচ্ছে!”

“কিন্তু কেউ কিছুই করছে না কেনো?” 

এইবার নীলোর কণ্ঠে আতঙ্ক। “তোমার কি মনে হচ্ছে, বাবা? কি ঘটে থাকতে পারে আসলে?” মিস্টার লোপেজ ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না এর উত্তরে কি বলবেন তিনি। তার কাছে কি সত্যিই কোন ব্যাখ্যা আছে?

তার মন নীলোর দিকে ফিরে গেল আবারও। নৌকাটা কেন পরিত্যক্ত তার একটা ব্যাখ্যা ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছে ছেলেটা। ওর কথায় একরকম দৃঢ়তা আছে; আছে আত্মবিশ্বাস। আর ওকে বিশ্বাস করতে হবে এমন একটা দাবিও কোথাও যেন আছে ওর কন্ঠস্বরে। 

নৌকাটা, কিংবা, সেটার সাথে ঘটে যাওয়া কোন অঘটন নিয়ে কোনপ্রকার ভাবনা মিস্টার লোপেজের মনকে নাড়া দিচ্ছে না আর। কোন কিছুর ব্যাখ্যা যদি সে খোঁজে, অথবা কোন কিছুর ব্যাখ্যা দিতে যদি সে দায়বদ্ধ থাকেই, তবে তা হলো তার নিজের ব্যর্থতার। আর নীলোর অসফলতার পিছনে তার নিজস্ব দায়ের। সে বেশ বুঝতে পারছে, নীলোকে আর মিথ্যে বলা ঠিক হবে না; এমনকি নীলোর সম্পর্কে বানোয়াট কথা বলারও কোন অবকাশ নেই আর। কারণ, খুব শীঘ্রই সেই সময়টা চলে আসবে যখন সে চাইলেও কোনপ্রকার ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে পারবে না; প্রকৃত সত্যটা তাকে নীলোর কাছে স্বীকার করতেই হবে। 

তাছাড়া আর কতদিনই বা সম্ভব তার পক্ষে? ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ডীন, সিগার কিংবা এই পানামা খাল কোনটার জন্যই অর্থের যোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না আর। শুধুশুধু এই অর্ধসত্য, অসত্য কথাগুলো তার প্রতিটা দিনকে কয়েকগুণ কষ্টসাধ্য ও ভারাক্রান্ত করে তুলছে। বাস্তবতাকে মেনে না নেওয়াটা হয়ত একরকমের ফ্যাশন বা বিলাসিতা হতে পারে। কিন্তু তেমন সৌখিনতা খুব বেশিদিন চালিয়ে যাবার উপায় আছে কি? হায় জীবন! রহস্যময়তা আর একাকীত্বে ভরপুর! মনে মনে এসব ভেবেই চললেন তিনি। নীলো ছাড়াও তো আরও কয়েকটা ছেলে আছে তার। স্কুলে পড়া একটা কিশোরী মেয়েও আছে। তার পরিবারের ষষ্ঠ সদস্যটা তো এখনও মাতৃগর্ভের অচেনা গহীনে। আর যে বিষয়টা অবশ্যম্ভাবী তা হলো, এই সবগুলো মানুষের ভরণপোষণের বিশাল দায়ভার তাকে একা বহন করতে হচ্ছে । আর তা করতে করতে কখন যে তিনি এমন কঠোর একজন মানুষে পরিণত হয়েছেন তা তিনি নিজেই জানেন না। আর কেউ যখন একবার এই কঠোরতা আর নির্মমতা নিজের মধ্যে তৈরি করে ফেলে, তখন সে একজন ভয়ঙ্কর মানুষ। লোপেজ সাহেবও এখন তেমনই। 

ফেরিটা এখন সেই দ্বীপটার সীমানা পেরিয়ে আবারও মূল চ্যানেলের মধ্যে  দিয়ে পানি কেটে কেটে সামনে এগুচ্ছে। সবুজ ঝোপ, সাদা সৈকত, পরিত্যক্ত নৌকা- কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। তবে নৌকার মাস্তুলটাকে কি পানির উপর দিয়ে এখনও একটুখানি দেখা যাচ্ছে? নাকি তার চোখের ভুল? একটু পর সেটাও যেন চলে গেল দৃষ্টিসীমানার বাইরে। ক্যালাপান বন্দরটি কাছে চলে এসেছে এখন। তীরবর্তী ভবনগুলোর ধাতব ছাদ পাহাড়ের বিপরীত দিক থেকে আসা তির্যক সুর্যরশ্মিতে সফেদ হয়ে আছে। এক মুহুর্তের জন্য লোপেজ সাহেব নীলোকে দেখলেন। নতুন বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাত রেলিংয়ে, চোখ ঝকমকে উজ্বল। এই ছেলেটার বাবা সে! আকস্মিক এক পুলক আর অদ্ভুত এক তৃপ্তি গ্রাস করে ফেলল মিস্টার লোপেজের সমগ্র চেতনাকে। তার মনে হল, তার নিজের চোখও জ্বলজ্বল করছে। ডেকটি পায়ের নিচে প্রচন্ড দুলতে শুরু করল হঠাৎ। ঢেউগুলি আবারও কিছুটা শান্ত হয়ে আসলো অল্পক্ষণেই। কাঠের বেঞ্চটাতে স্থির হয়ে বসলেন তিনি, বুঝতে পারছিলেন তার অস্তিত্ত্বের মূলে শক্ত কিছু একটা দানা বাঁধছে যেন ।

“না! কোনভাবেই না!” নিঃশব্দে প্রার্থনা করতে লাগলেন মিস্টার লোপেজ। নীলোর সেই পীড়া এবার যেন তাকে পেয়ে বসেছে। ভয়ে গুটিয়ে গেলেন তিনি। অনুভব করতে পারছেন যে এটাকে আর দমিয়ে রাখা যাবে না…

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *