মাঝরাস্তার পরিবার// মূল: সিলা খোমচাই// অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল মামুন

আমার বৌ ভীষণরকম গোছান। সবদিকেই তার নজর। আমি যদি তাকে বলি যে বিকেল তিনটায় আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে (ক্লংসান এলাকায় নদীর ধারের হোটেলে এক বড় খরিদ্দারের সাথে আমার বসের যে মিটিং আছে সেখানে আমাকে থাকতে হবে), সে সিদ্ধান্ত দেবে আমাদের ন’টায় বের হতে হবে কারণ সাফান খোয়াইয়ের আশেপাশে কোন এক জায়গায় দুপুরের আগেই তাকে থাকতে হবে। আমাদের দুজনেরই ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য এ তার চমৎকার পরিকল্পনা।

আরো আরো কারণে তার ধন্যবাদ প্রাপ্য। আমাদের গাড়ির পেছনের সিটের দিকেই তাকান না। সে সেখানে রেখেছে ফাস্টফুডের একটা ঝুড়ি, বোতলজাত পানীয়তে পূর্ণ একটা আইসবক্স, হরেক রকমের কেক এবং মুখরোচক খাবার, সবুজ তেঁতুল, স্টার গুজবেরি, একটি সল্ট শেকার, আবর্জনার জন্য একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ, আর একটি মূত্রদানি। এমনকি আয়নার ওপরের কবজা থেকে ঝুলছে এক সেট কাপড়। মনে হচ্ছে আমরা পিকনিকে যাচ্ছি।

তাত্ত্বিকভাবে আমরা মধ্যবিত্ত। সে রকমটাই নির্দেশ করে আমাদের বাড়ির অবস্থান যা লুম লুক কা এবং ব্যাং খেনের মধ্যে ব্যাংককের উত্তর আবাসিক শহরতলিতে অবস্থিত। আমাদের বাড়ি থেকে শহরে ঢোকার জন্য, আপনি একের পর এক এবং আরও অনেক আবাসন প্রকল্পের পাশ দিয়ে যান, তারপর ফাহোনিওথিন রোডে ২৫ কিলোমিটারে যান, তারপর চেইসিমাখোট-ব্রিজ থেকে ভিফাবাদি-রঙ্গসিট-হাইওয়েতে যান এবং সেখান থেকে ব্যাংকক। এটাই সহজ পথ।

আমরা যদি দরিদ্উর শেণির হতাম, তাহলে আমরা হয়ত শহরের কেন্দে কোন বস্তিতে উবু হয়ে বসে থাকতাম। উচ্চবিত্তের লোকেরাও সেই এলাকাতেই বাস করে, শহরের কেন্দ্রে কোনো কন্ডোমিনিয়ামে, যেখানে তারা ঢেউ খেলান নদীতে প্রতিফলিত সোনালী সূর্যাস্ত দেখতে পারে।

তার চেয়েও গুরুত্বপর্ণ যেটা সেটা হল তাদের সোনালী স্বপ্নগুলো সতত ঝলমল করে।

উচ্চশ্রেণির লক্ষটি বোঝা খুব সহজ, কিন্তু কীভাবে সেখানে পৌঁছাতে হয় সেটাই সমস্যা। সেটা মনে রেখেই আমরা সব পরিকল্পনা করার সময় পাগলের মতো কাজ করি। আমাদের সব আশা এবং পরিকল্পনা হল কিভাবে আমাদের একটা নিজস্ব ব্যবসা হবে এবং কোনো সন্দেহ নেই এ ঘোরেই আমাদের প্রতিটা দিন কাটে। আর এর মধ্যেই আমাদের যা কিছু অর্জন করার সাধ্য তা অর্জন করেছি: আমাদের নিজস্ব বাড়ি আর গাড়ি।

গাড়ি থাকার কারণ কী? এটা যে মর্যাদা বাড়ায় তা অস্বীকার করব না। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ঝলসে যাওয়া রাস্তায় যানজটের মধ্যে পুরো আটকে থেকে বা ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগুনো বাসের মধ্যে স্ট্র্যাপের সাথে ঝুলে থেকে তিন চার ঘন্টা ধরে কুঁচকে যাওয়া, দুমড়ে যাওয়া, পিষ্ট হওয়া থেকে শরীর প্রতিবাদ করতে শুরু করে। ফলে একটি গাড়ি থাকলে আপনি অন্তত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শীতলতায় ডুবে যেতে পারেন, আর আপনার প্রিয় গান শুনতে পারেন। স্বীকার করতেই হবে যে এ এক অসীম সৌভাগ্য।

এসব নিয়ে ভাবতে অদ্ভুত লাগে। এখন আমার বয়স ৩৮ বছর। রাত এগারোটায় ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে যখন বাড়ি ফিরি তখন বিছানায় শুতে যাবার মতো সহজ কাজটির জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার দরকার হয়। অথচ এই আমি স্কুল ফুটবল দলে মাঝমাঠে খেলতাম এবং খ্যাত ছিলাম ডাইনামো নামে। এখন মনে হয় আমার শরীরের প্রতিটি পেশী-স্নায়ু ঢিলে হয়ে গেছে, হারিয়ে ফেলেছে তার গতি, তার কার্যকারিতা।

সম্ভবত এটি অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফল। কিন্তু রেডিওতে গানের ফাঁকে আমি শুনেছি দুষিত বায়ু আর এর বিষাক্ত উপাদানগুলো আমাদের শরীরযন্ত্রকে ক্ষয় করে দিচ্ছে। তবে নিশ্চিতভাবেই, আমাদের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ আমাদের শক্তিকে শুষে নিচ্ছে।

সুতরাং, গাড়ি প্রয়োজন, একটি আশ্রয়। আপনি বাড়ি এবং অফিসের মতো এটিতেও সময় ব্যয় করেন। এবং যখন আপনার বউ এটিকে যথাসম্ভব আরামদায়ক এবং সুবিধাজনক করে তোলেন তখন এটি একটি সত্যিকারের বাড়ি, একটি চলন্ত অফিসে পরিণত হয়।

এভাবে আমি ব্যাংককের যানজটে আর হতাশ হই না। কত লক্ষ গাড়ি রাস্তায় আটকে আছে তাতে আর কিছু যায় আসে না, গাড়ির ভিতর রাতযাপন স্বাভাবিক। গাড়ি-জীবন পারিবারিক সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে। আমার সত্যিই এটা পছন্দ। কখনও কখনও এক্সপ্রেসওয়েতে আটকে থাকলে আমরা একসাথে দুপুরের খাবার খাই। এটা খুব মজার, সুখের। গাড়ি যখন এক ঘন্টা বা তার বেশি সময় ধরে আটকে থাকে, তখন আমরা বেশ মজা করি।

‘চোখ ঢাকো’, বউ বলে।

কারণ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করি ‘কেন?’

‘ঢাকোতো’ বলে সে পিছনের সিট থেকে মূত্রদানী তুলে এনে নিচে রেখে তার স্কার্টটি উঁচিয়ে ধরে স্টিয়ারিং হুইলের নিচ দিয়ে নিচের দিকে নেমে যায়। চোখঢাকা আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে আমি তার পরিচিত শরীর দেখি। রাস্তার মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত আমার ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করে তোলে।

‘তুমি দুষ্টুমি করছ’ বলে সে কৃত্রিম রাগে আমার দিকে তাকায় আর তার লজ্জা ঢাকতে আমার উপর বেশ কটা থাপ্পড় কষে।

জনস্বাস্থ্য মন্ত্রকের পরামর্শ মতো আমরা একটি পরিণত বয়সে বিয়ে করেছি, এবং একটি পরিবার শুরু করার আগে সঠিক সময় ও সঠিক প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা করার শ্লোগানটি কঠোরভাবে মেনে চলেছি। আমরা প্রাদেশিক লোক যাদেরকে বড় শহরে পৌঁছাতে এবং ভাগ্য গড়তে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তাই অবশেষে যখন আমরা সন্তানাদির জন্য প্রায় প্রস্তুত তখন আমার বয়স আটত্রিশ এবং আমার স্ত্রীর বয়স পঁয়ত্রিশ এবং শারীরিকভাবে বলতে গেলে আমরা এটার জন্য খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। এগারোটায় ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে মধ্যরাতের পর ক্লান্তি নিয়ে বিছানায় গেলে এগুলো আর সহজ থাকে না। বাসনা আছে কিন্তু রসায়ন দুর্বল, এবং যেহেতু আমরা খুব কমই এটি করি তাই সন্তানাদির সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।

একদিন আমি উজ্জ্বল এবং প্রফুল্ল হয়ে ঘুম থেকে উঠলাম, বেশ ভাল ঘুম হয়েছে। হ্যাঁ, উৎফুল্লতায় আমি জেগে উঠলাম, সূর্যালোককে আমাকে আদর করতে দিলাম, তাজা বাতাসে শ্বাস নিলাম, সাম্বা নাচের কটি মাত্রা নেচে নিলাম, শ্যাম্পু করে স্নান করলাম এবং এক গ্লাস দুধ খেলাম ও দুটি নরম-সিদ্ধ ডিম খেয়ে ফেললাম। আর সেই পুরোনো মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের মতো চনমনে হয়ে উঠলাম।

ভিফাবাদি-রঙ্গসিত-রোডে যান চলাচল ব্যাহত, রেডিওতে ঘোষণা করল আমার প্রিয় ডিজে। একটি দশ চাকার ট্রাক সবেমাত্র থাই এয়ারওয়েজ ইন্টারন্যাশনালের হেড অফিসের সামনে একটি ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়েছে। রাস্তা পরিষ্কার চলছে।

আমি বলিষ্ঠ আর অন্তরঙ্গ বোধ করছিলাম।

বামদিকের গাড়িতে দুই কিশোর-কিশোরী, কিংবা কেবল বিশ পেরিয়েছে, একে অপরের সাথে খুনসুটি করছিল। ছেলেটি মেয়েটির চুলে আঙ্গুল চালাল। মেয়েটি তাকে চিমটি দিল। সে মেয়েটির কাঁধে হাত দিয়ে তাকে কাছে টেনে নিল। মেয়েটি তার পাঁজরে কনুই দিয়ে খোঁচা দিল।

জীবন্ত হয়ে উঠলাম যেন আমি নিজেই সেগুলো করছিলাম। আমার বউয়ের দিকে তাকালাম এবং তাকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হল। তার মুখ ছেড়ে তার উত্থিত বুক, তারপর তার উরু এবং হটিতে চলে গেল আমার চোখ। গাড়ি চালানোর সুবিধার্থে তার খুব ছোট স্কার্টটি বিপজ্জনকভাবে উপরের দিকে উঠানো।

‘তোমার পাগুলো খুব সুন্দর’ বললাম তাকে। আমার গলা কেঁপে উঠল, দ্রুত স্পন্দিত হল বুক।

‘পাগল নাকি’, সে বলল, হালকা তালে। তার যত্নে লালিত নখগুলো থেকে মুখ তুলে সে তাকাল, দেখলাম তার ঘাড়ের মসৃণ ত্বক ও আভা।

আমি শক্ত করে ঢোক গিললাম, চোখ সরিয়ে নিলাম, অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার সেই রূপ আমার কল্পনায় আগ্রাসী হয়ে উঠল। ভিতরের জন্তুটি জেগে উঠেছে, বিশেষ করে সেই উচ্চতর জন্তু যে তার জান্তর ক্ষুধা নিয়ে নতুন অজানা বাসনার সন্ধান করে।

স্থবির জানজটে আমি চারপাশের গাড়িগুলো খেয়াল করতে করতে আমার হাত চ্যাটচ্যাটে হয়ে উঠল। আমাদের মতই সবারই টিন্টেড জানালা। আমাদের গাড়িটা ভেতর খুব শীতল ও আরামদায়ক। রেডিও থেকে পিয়ানো কন্সার্টো পানির মত প্রবহমান, তবুও শান্তভাবে টালমাটাল। আমার কম্পমান হাত টিন্টেড জানালার উপর আলোনিরোধী প্লাস্টিক পর্দা টেনে দিল। সেই মুহূর্তে আমাদের একান্ত জীবন মাধুর্য ও আলোয় ভেসে গেল।

এটা আমি জানি: আমরা মানুষেরা আমাদের বাইরের এবং আমাদের ভিতরের প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি এবং এখন আমরা শহর-বাস, দূষণ, শ্বাসরোধকারী যানবাহনে আটকে গেছি; আর এ সবই আমাদের স্বাভাবিক পারিবারিক কার্যক্রমের ছন্দ ও গতিকে ধ্বংস করেছে। জীবনসংগীতের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হচ্ছে, বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

সম্ভবত দীর্ঘ বঞ্চনার কারণে, এছাড়াও একটি শিশুর জন্য মাতৃত্বের আকুলতা এবং অন্য কিছু কারণে, “তুমি আমার কাপড় নষ্ট করছ” সহ তার বাকি আপত্তিগুলি হারিয়ে গেল আমাদের মাঝরাস্তার স্বর্গীয় বাসরঘর তৈরি ও উপভোগ করবার জরুরি চাহিদার কাছে।

একত্রিত থাকা সবসময়ই আমাদের বিবাহিত জীবনের একটি বৈশিষ্ট্য: ক্রসওয়ার্ড, স্ক্র্যাবল এবং অন্যান্য খেলা যা আমরা জানি। এগুলোকে আবারো আমরা একসাথে চিনলাম, এবং আমরা যখন প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম সেরকম হয়ে গেলাম। রেডিও স্টেশনগুলি ব্যাংককের ক্রমবর্ধমান যানজট সম্পর্কে আপডেট দিচ্ছে: পুরো সুখুমভিট, ফাহোনিওথিন, রামকামহেং, রামা চতুর্থ। পুরোটা স্থবির হয়ে আছে।

আর আমার জন্য মনে হচ্ছিল যেন আমি আমার নিজের বসার ঘরে, আমার প্রিয় সোফায় শুয়ে আছি।

খ.

আমার পরিকল্পনাগুলির মধ্যে একটি গাড়ি সম্পর্কিত। আমার একটা বড় গাড়ি দরকার যেটায় খাওয়াদাওয়া, খেলা, ঘুমানো, মলমূত্র ত্যাগ সবকিছুর জন্য যথেষ্ট জায়গা থাকে। আর কেনই বা নয়?

আজকাল আমি যানজটের মধ্যে আটকে থাকা চারপাশের লোকজনের সাথে যোগাযোগ তৈরি করি। থেমে থাকা গাড়িগুলো থেকে কিছু যাত্রী একটু হাঁটতে বা হাতপা টান করতে নেমে পড়ে। আমিও নামি। আমরা একে অপরকে অভিবাদন জানাই এবং এটা সেটা নিয়ে আলাপ করি: স্টক এক্সচেঞ্জের খবর নেই, রাজনীতি নিয়ে কথা বলি, অর্থনীতি, ব্যবসা, খেলাধুলা ইত্যাদি নিয়ে আলাপ চলে।

রাস্তার এই প্রতিবেশীদের মধ্যে আছে: খুন উইচাই, স্যানিটারি তোয়ালে তৈরির একটি ফার্মের বিপণন পরিচালক; খুন প্রচয়া, একটি সীফুড ক্যানারির মালিক; খুন ফানু, সহজে ইস্ত্রি করার জন্য একটি রাসায়নিক দ্রবণের প্রস্তুতকারক। আমি তাদের সকলের সাথে কথা বলতে পারি, কারণ আমি বিজ্ঞাপনে কাজ করি এবং ভোক্তাদের মনোভঙ্গি এবং পছন্দ আমার কাছে প্রয়োজনীয় তথ্যউপাত্ত আছে। অবশ্যই বলব যে এই রাস্তায় তৈরি সম্পর্ক থেকে আমি বেশ কিছু গ্রাহক পেয়েছি।

স্বাভাবিকভাবেই, আমার মতো পরিশ্রমী লোককে আমার কর্তার খুব পছন্দ। তিনি আমাকে তার ডান হাত মনে করেন। আমাদের আজকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট হল একেবারে নতুন ‘স্যাটো-ক্যান’ নামক কোমল পানীয়ের মালিকের সাথে। আমরা তাকে একেবারে শুরু থেকে পণ্যের প্রচার নিয়ে সাহায্য করব, কানের জন্য আকর্ষক, চোখের জন্য আরামদায়ক, ঠোঁটের জন্য লাস্যময় এমন একটি ব্র্যান্ড নাম থেকে শুরু করে বিস্তারিত তথ্যাবলী সহযোগে দীর্ঘমেয়াদী প্রচারকৌশল সম্পর্কিত সমূহ বিষয় তার সামনে উপস্থাপন করব। আশা করি তার বার্ষিক বাজেট প্রচারমাধ্যমে প্রচার, সূক্ষ্ম সুনাম তৈরি, ফলোআপ ইত্যাদি বিষয়ে খরচের যথেষ্ট সুযোগ দেবে। আমাদের দীপ্ত প্রস্তাবগুলো কার্যকর ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে আমি বসকে সহযোগিতা করব।

গ.

এখন শোয়া এগারোটা বাজে। অ্যাপোয়েন্টমেন্ট তিনটায়। অনেকটা সময় আছে আমার দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা করার আর স্বপ্ন দেখার সেই নতুন গাড়ি নিয়ে যেটা হবে আরো প্রশস্ত, আরো মানানসই। আমার মনে হয় এটা কোনো অসম্ভব স্বপ্ন নয়।

আরেকবার আটকা পড়তে যাচ্ছি… সামনে যানবাহনের বিশাল লম্বা সারি। কিন্তু ঠিক এখানেই সেই স্মরণীয় দিনে আমরা দুজনে রৌদ্রালোকের মধ্যে টিন্টেড জানালায় আলোনিরোধী প্লাস্টিক শিট টেনে আমাদের বাসর সাজিয়েছিলাম…

আমি হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করি। অ্যাপোয়েন্টমেন্টের কথা ভাবার চেষ্টা করি, কিন্তু আমার হৃদয় দ্রুতধাবমান।

যেন আবেগের জাদু এখনও রাস্তার এই অংশে ভেসে আছে। কিষে হয়েছিল সেদিন.. এমন এক অনুভূতি যেন অনুচিত কিছু করছি, যা লুকিয়ে রাখতে হয়, যা তাড়াহুড়ো করতে হয়। ছোট্ট জায়গার মধ্যে শরীরদুটোকে আটানো ছিল কষ্টকর। এটা সাহসী ও উত্তেজনা ঠাসা, ঠিক ছোটবেলায় পাঁচিল ডিঙিয়ে মন্দির থেকে গাব চুরি করা যেন…।

…তার সুন্দর পোশাক দলামোচড়ানো, এবং তা শুধু আমার আক্রমণের কারণে নয়। তার ক্ষুধার্ত সাড়া গাড়িকে গরম করে ফেলেছিল যেন আমরা এসি দিতে ভুলে গেছি। সে হিংস্রভাবে আমার হাত আঁকড়ে ধরল, তারপর আমার কাঁধ, সেখানে তার নখের আঁচড়ের ব্যথা অনুভব করলাম।

আমি আলোনিরোধী শিট টেনে নামিয়ে দিই।

‘না’ সে ফোঁপায়, তারপর আমার চোখের দিকে তাকায়। ‘জানি না আমার কি হয়েছে। বমিবমি লাগছে।’

লম্বা শ্বাস নিয়ে আমি অন্য দিকে তাকাই, নিজেকে সামলে নিয়ে খাবারের ঝুড়ি টেনে নিই এবং একটা স্যান্ডউইচ তুলে নেই যেন আসল ক্ষুধা এভাবেই মিটে। আমার বউ, যাকে মোটেও সুস্থ মনে হচ্ছিল না, একটি সবুজ তেঁতুল চিঁবোয় এবং চনমনে হয়ে উঠে।

স্যান্ডউইচ শেষ করে আমি গাড়ি থেকে নেমে পড়ি এবং যারা নিচে নেমে ছিল তাদের দিকে তাকিয়ে নিবোর্ধ এক হাসি দেই, তাদের কেউ কেউ হাত দোলাচ্ছিল, কেউ মাজা বাঁকাচ্ছিল, কেউ এদিক ওদিক পায়চারি করছিল। পরিবেশটি একটি আবাসিক কমপ্লেক্সের মতো যেখানে বাসিন্দারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্যায়াম করছে। মনে হচ্ছে একই কমপ্লেক্সের প্রতিবেশী আমরা।

মধ্যবয়সী একজন কোদাল নিয়ে রাস্তার ট্রাফিক আইল্যান্ডে কি যেন খুঁড়ছে। উদ্ভট, কিন্তু কৌতূহলজনকও।

তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কি করছেন?’

‘একখান কলা গাছ লাগালাম,’ কোদালের দিকে তাকিয়ে তিনি উত্তর দেন। কাজ শেষ করেই হাসিমুখে আমার দিকে তাকান। ‘কলার পাতা দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বড় আর বাতাসের অনেক বিষাক্ত উপাদান শোষণ করতে পারে।’ তিনি পরিবেশবাদীর মতো কথা বলেন। “যখনই জানজট হয় আমি এটা করি। চাইলে আপনিও একটা লাগাতে পারেন। আমরা এখানে বেশ কিছুক্ষণ থাকব। রেডিও বলছে সাত-আটটি গাড়ির সঙ্গে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, একটি লাড ফ্রাও ব্রিজের পাদদেশে, অন্যটি মো চিট স্টেশনের সামনে।’

তিনি কোদাল আমার হাতে দিলেন। ‘ঠিক আছে,’ আমি বলি। ‘খুব শীঘ্রই আমাদের এখানে একটি কলার বাগান হবে।’

আসলে, আমি এই ধরণের কাজের সঙ্গে অপরিচিত নই, আমার আগের প্রদেশে গ্রামের ছেলে হিসাবে ছোটবেলায় এরকম কাজ করেছি। কোদাল, মাটি এবং কলাগাছ আমাকে শুধু একঘেয়েমি থেকে উদ্ধারই করে না, দীর্ঘদিনের ভুলে যাওয়া দিনগুলিতে ফিরে নিয়ে যায়, যার জন্য আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ বোধ করি।

‘যদি এই ট্রাফিক আইল্যান্ডটি গাছে ভরে যেত’ তিনি বলেন, ‘তাহলে সুন্দর হতো, গাছভর্তি বাগানের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালানোর অনুভূতি হতো।’

বাগানের দেখাশোনা আর ভিজিটিং কার্ড বিনিময়ের ফাঁকে তিনি আমাকে তার গাড়িতে এক কাপ কফি খেতে বলেন। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ক্ষমা চাই কারণ আমি গাড়ি থেকে অনেকক্ষণ দূরে এবং আমার ফেরা উচিত।

ঘ.

‘আমার মনে হয় না আমার গাড়ি চালান ঠিক হবে।

তুমি দয়া করে একটু চালাও।’

তার মুখ ফ্যাকাশে, বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে তার মুখের কাছে প্লাস্টিকের ব্যাগ ধরে আছে।

‘ব্যাপারটা কি?’ আমি জিজ্ঞাসা করি, আমি অবাক তাকে এ অবস্থায় দেখে। ‘মাথা ঘুরছে, অসুস্থ?’ ‘ডাক্তার দেখাতে হবে?’

‘এখন না।’ সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল। ‘গত দুই মাস আমার পিরিয়ড হয়নি। মনে হয় আমি গর্ভবতী।’

আমার দম আটকে গেল আর নিজের মনে ‘হুররে, হুররে’ বলে চিৎকার করবার আগে দুয়েক মুহূর্তের জন্য যেন কাঠের গুড়ির মতো অনুভূতিশূন্য হয়ে গেলাম। সে প্লাস্টিকের ব্যাগে বমি করল… বমির শব্দ এবং গন্ধ আমাকে মোটেও বিরক্ত করল না। আমার মনে হল গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে চিৎকার করে বলি:

‘আমার বউ গর্ভবতী। শুনতে পাচ্ছ তোমরা? সে গর্ভবতী। আমরা রাস্তার উপর এটা করে ফেলেছি।’

গাড়ি চলা শুরু করলে আমি চালকের সিটে বসি, এবং সেই ছোটটির স্বপ্ন দেখি যে আমাদের জীবনকে সম্পূর্ণ করে তুলবে, এবং একটি নতুন বড় গাড়ির স্বপ্ন দেখি যেটি বাবা, মা এবং শিশুর জন্য আরামদায়ক এবং একটি পরিবারের দৈনন্দিন নানাবিধ জিনিসপত্রের জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত হবে।

বড় একটি গাড়ি প্রয়োজন। আমরা যদি রাস্তার উপর চিরটাকাল সুখে থাকতে চাই তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের এটি পেতে হবে।

You sent

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *